WhatsApp Image 2022-09-04 at 9.30.16 AM

ব্যবস্থাপনার নীতি

আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক হেনরি ফেয়ল (Henry Fayol) ১৯১৬ সালে ফ্রান্সে তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ জেনারেল অ্যান্ড ইনডাসট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট (General and Industrial Management) এ ১৪টি ব্যবস্থাপনা নীতি প্রদান করেছেন; এই নীতিগুলোই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হিসেবে মানা হয়।

হেনরি ফেয়লের ব্যবস্থাপনার ১৪ টি নীতি:

১. কার্যবিভাগ (Division of work)

 প্রতিষ্ঠানের কাজকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে সুষ্ঠুভাবে নির্দিষ্ট করার নীতিকেই কার্য বিভাজন নীতি বলে।

২. কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব (Authority and Responsibility)

 কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব পরস্পর ঘনিষ্ঠতার সাথে সম্পর্কিত। কোনো কর্মীকে কার্য সম্পাদন করার জন্য কর্তৃত্ব অর্পন করার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব ও প্রদান করতে হবে। আবার এরূপ কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য থাকা উচিত অন্যথায় কার্যক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।

৩. আদেশের ঐক্য (Unity of Command)

আদেশের  ঐক্য নীতির মূল কথা হলো প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কর্মী শুধু একজন বসের (Boss) অধীনে থাকবে এবং তার আদেশ গ্রহণ করবে। কারণ একাধিক বসের অধীনে একজন কর্মী সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে না। এক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা এবং সমস্যাই দেখা দেয়।

৪. নির্দেশনার ঐক্য (Unity of Direction)

উদ্দেশ্যে অর্জনের জন্য পূর্ব নির্দেশনার সাথে মিল রেখে পরবর্তী নির্দেশনা প্রদানের কাজকে ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনার ঐক্য নীতি বলে।

৫. কেন্দ্রীকরণ      বিকেন্দ্রীকরণ(Centralization and Decentralization)

উওরঃ প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিচের পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলে তাকে বিকেন্দ্রীকরণ বলে।

৬. সাম্য (Equity) 

সকল শ্রমিক ও কর্মীর প্রতি সমান এবং সম্মানজনক আচরণ করা উচিত। একজন ব্যবস্থাপক বা প্রশাসকের দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কেউ যেন  বৈষম্যের সম্মুখীন না হয়। 

৭. নিয়মানুবর্তিতা (Dicipline)

প্রতিষ্ঠানের জন্য উত্তম নিয়ম নীতি নির্ধারণ এবং তা মেনে চলার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় নিয়মানুবর্তিতার নীতি বলে। এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনগণ যদি নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন তবে প্রতিষ্ঠানে নিয়মানুবর্তিতার নীতি অনুসরণ সহজ হয়।

৮. শৃঙ্খলা (Principal of Order)

যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে এবং সঠিক বস্তুকে সঠিক স্থানে স্থাপনের নীতিকে ব্যবস্থাপনায় শৃঙখলার নীতি বলে ।

৯. সাধারণ স্বার্থের জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ (Subordination of individual to general interest)   

ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রাতিষ্ঠানিক বা সাধারণ স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদান এর নীতিকে ব্যবস্থাপনায় সাধারণ স্বার্থে নিজস্ব স্বার্থ ত্যাগের নীতি বলে ।

১০. চাকরির স্থায়িত্ব (Stability of tenure)   

এই নীতি অনুযায়ী মনে করা হয় যে, কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা বিধান করা হলে তা কর্মীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে। চাকরির স্থায়ী কে কর্মীরা  গৌরবের বিষয় মনে করে।

১১. উদ্যোগ (Initiative)

নতুন নতুন পদ্ধতি বা উপায় উদ্ভাবন ও আবিস্কার করার পক্ষে কর্মীদেরকে উৎসাহ প্রদান করা হেনরি ফেয়লের গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য যথোপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এতে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কর্মীদের আগ্রহ বাড়ে এবং উন্নত কর্মনৈপুণ্য প্রদর্শন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। 

১২. জোড়া-মই-শিকল (Scalar Chain)

প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত কর্তৃত্ব প্রবাহের একটি শিকল বা চেইন থাকবে। এই শিকল কর্তৃত্বের প্রবাহ ও যোগাযোগের উর্ধ্বগতি বা নিম্নগতি নির্দেশ করে। জরুরি কাজে সংগঠনের নীচু স্তরের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা থাকবে। 

 

১৩. পারিশ্রমিক (Remuneration)

ন্যায্য বেতন এবং মজুরি নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মীদের প্রাপ্য। তাই বেতন ও মজুরির একটি উপযুক্ত কাঠামোর প্রবর্তন করে শ্রমিক-কর্মীদেরকে সর্বাধিক সন্তুষ্টি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। হেনরি ফেয়লের মতে, পারিশ্রমিক ন্যায্য হতে হবে এবং তা প্রদান করার যুক্তিসংগত বা সঠিক পন্থা থাকতে হবে। 

১৪. একতাই বল (Esprit de corps/Unity Is Strength) 

যেখানে একতা সেখানেই শক্তি। ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রধান নীতি হলো একে অপরকে  অনুপ্রাণিত করা এবং নিয়মিতভাবে একে অপরের সহায়ক হওয়া। একটি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং বোঝাপড়ার বিকাশ একটি ইতিবাচক ও প্রত্যাশিত কর্মপরিবেশ ও ফলাফলের দিকে পরিচালিত করবে। ব্যবস্থাপকের উচিৎ তার অধীনস্থ কর্মচারীদের দলগত প্রচেষ্টা, একতা ও ভ্রাতৃত্ব বোধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং এভাবেই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব।

ব্যবস্থাপনা নীতিমালা হচ্ছে ব্যবস্থাপকীয় কার্যাবলী সুষ্ঠুভবে সম্পাদনের নির্দেশিকা স্বরূপ। 

জারকা সুলতানা

ভাইস প্রিন্সিপাল এন্ড সহকারী অধ্যাপক

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

Nelufa madam blog

কলা ও এর পুষ্টিগুন

কলা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ফল। কলা এমন একটি ফল যা সারাবছর পাওয়া যায়। বাজারে বিভিন্ন ধরনের কলা পাওয়া যায়— যেমন, শবরি কলা, চম্পা কলা, সাগর কলা ইত্যাদি। এগুলো আমরা সবাই  চিনি তবে আমাদের বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের  উদ্ভাবিত কিছু জাত আছে— যেমন— অগ্নিশ্বর, কানাইবাসী, মোহনবাসী, জামাইষষ্টী অনেকেই চিনি না। কলা খুবই সুস্বাদু সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর ফল। কলা দিয়ে বিভিন্ন মুখরোচক খাবার বানানো যায়। বনের সব চেয়ে বড় প্রাণী অর্থাৎ বড়বাবু হাতির প্রিয় খাবার কলা মানে কলাগাছ। ফল হিসেবে কলার অনেক ঔষধি গুন রয়েছে। প্রচলিত একটি কথা আছে, কেউ যদি দিনে একটি কলা খায়; তাহলে তার বাড়িতে ডাক্তারের দরকার হয় না। তাহলে চলুন আমরা এই কলার পুষ্টিগুণ জেনে নেই।

কলা আপেলের চেয়ে দামি বাজারে আপেলের দাম বেশি কলার দাম কম, কিন্তু কলার পুষ্টিগুন আপেলের দ্বিগুন যেমনÑ আপেলে যে পরিমান প্রোটিন আছে তার চেয়ে চার গুন বেশি প্রোটিন কলায় আছে। এছাড়াও কলার Ñ কাবোর্হাইড্রেই আছে। দ্বিগুন ফসফরাস আছে তিনগুন ভিটামিন ‘এ’ও আয়রন আছে। পাঁচগুন, এতে ফ্যাট নেই বললেই চলে এজন্য কলা আপেলের চেয়ে দামি।

* শক্তি জোগাতে কলা-

কলার সুক্রোজ, ফ্রুরেষ্টিজ ও গ্লুকোজ তিন ধরনের প্রাকৃতিক সুগার আছে এবং প্রচুর পরিমানে আঁশ পাওয়া যায়। খাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই শক্তি পাওয়া যায়।

* হতাশগ্রস্ত মানুষের জন্য কলার ম্যাজিক – অধিকাংশ মানুষই হতাশায় ভোগেন, তাদের জন্য সুখবর হলো, এ হতাশ দুর করার জন্য কলার জুড়ি নাই, কলায় আছে ট্রিপটোফ্যান নামক প্রোটিন, যা ম্যাজিকের মতো হতাশা দূর করে। রক্তশূন্যতা থেকে পরিত্রান— আমাদের বিশেষ করে মেয়েদের হিমোগ্লোবিনের পরিমান অনেকেরই কম থাকে  অনেক সময় রক্তশূন্যতা তা দেখা দেয়, যাকে অ্যানিমিয় বলে, এটি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা আয়রন ট্যাবলেট খাই, যদি প্রতিদিন একটি করে কলা খাই তাহলে এ থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়।

* বুক জ্বালাপোড়ায়— অনেক সময় হঠাৎ বুক জ্বালাপোড়া শুরু হয়, বুক থেকে শুরু হলেও এক সময় ঘাড়, গলা চোয়ালের কোনে কোনে ছাড়িয়ে পড়ে রোগটির নাম হার্টবার্ন, হার্টবার্ন হলে আমরা অ্যান্টিসিড জাতীয় ঔষধ সেবন করি। যদি আমরা ঔষধ না খেয়ে কলা খাই তাহলেই রক্ষা পাই কারন কলা অ্যান্টিসিড ইজেক্ট তৈরি করে।

* আঘাত থেকে সুরক্ষা মানুষ কোন কারনে আঘাত প্রাপ্ত হলে শরীরের বিপাকীয় হার বেড়ে যায় ফলে শরীরের পটাশিয়াম লেভেলটা ও কমতে থাকে। কলায় প্রচুর পটাশিয়াম আছে যা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাজতে ও পটাশিয়ামের লেভেল ঠিক রাখতে সাহয্য করে।

আসলে ফল আল্লাহর নিয়ামত প্রত্যেকটা ফলের মধ্যেই আল্লাহ তাআলা পুষ্টিগুন দিয়েছেন যা তার সৃষ্টির সেরা জীব অর্থাৎ আশরাফুল মাখলুকাতের জন্য রোগ নিরাময়ের মহাঔষধ।

নিলুফা ইয়াসমিন

সিনিয়র প্রভাষক

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

WhatsApp Image 2022-08-31 at 11.32.35 AM

বাঙালির চোখে সাদা-কালো

দেশে দেশে কালে কালে সাদার মাহাত্ম্য ধ্বনিত হয়েছে। সাদা মানেই সুন্দর। সাদা মানেই স্বর্গীয় কোনোকিছু। সাদা মানেই চোখ ধাঁধানো মন ভোলানো অপার রহস্যাবৃত মানসিক প্রশান্তির নিবাস। অপরদিকে কালো মানেই অন্ধকার। সব মুছে দেওয়ার কারিগর। কালো মানেই বিদঘুটে কোনোকিছু। কালো মানেই দুর্যোগের আভাস। কালো মানেই অভিশপ্ত নগরীর ধ্বংসপ্রাপ্ত ইটের গাঁথুনি থেকে ভেসে আসা ক্রন্দনরতার চিৎকার।

সাদার প্রতি দুর্বলতা এবং কালোর প্রতি প্রচ্ছন্ন ঘৃণা স্থান বিশেষে প্রকাশ্যে ঘৃণা আমাদের চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। আমাদের পোষা বিড়াল কিংবা কুকুরটির বহিরাবরণ যদি সাদা কিংবা সাদা গোত্রীয় রঙের হয়ে থাকে তাহলে পোষ্যগুলোর প্রতি আমাদের ভালোবাসাও জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। আবার, কোনো প্রতিষ্ঠানের কিংবা রাষ্ট্রের অনুষ্ঠানের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, সাদা কবুতর ওড়ানো হচ্ছে কারণ সাদা কবুতরকে শান্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সাদা কবুতরের পরিবর্তে যদি কালো কবুতর ওড়ানো হতো তাহলে কী পৃথিবী অশান্তির ভাগাড় হতো! এতো গেলো মামুলি পোষা প্রাণীর কথা। চামড়ায় মেলানিনের আধিক্যের দরুন মানুষের পৃথিবীতে মানুষের দ্বারা মানুষই সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের শিকার হয়।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ শোষণ, নিষ্পেষণ এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছে চামড়ার রঙের তারতম্যের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বর্বরতার ইতিহাস অনেক পুরাতন। সাধারণত কৃষ্ণাঙ্গদের নিগ্রো, আফ্রিকান কাফ্রি, বর্বর, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করতে আমরা অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর এই স্বাচ্ছন্দ্য মূলত ছন্দ-তাল-লয় পায় আমাদের শৈশব থেকেই। সাধারণত, শৈশব থেকেই আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় যে, ফর্সা মানেই সুন্দর এবং কালো মানেই ভয়ঙ্কর এবং কুৎসিত। কালোকে পূর্বেই একটি ছাঁচে ফেলে দেওয়া হয় এবং এই ছাঁচেই কালো সম্পর্কিত সমুদয় আদিম ধারণা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মস্তিষ্কের এই ছাঁচই যত্নের সাথে লালন করা হয়। ইউরোপে কৃষ্ণাঙ্গের প্রতি শ্বেতাঙ্গের ঘৃণা-বিদ্রূপ-অবহেলা অনেকটাই প্রকাশ্যে ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশে কালোর প্রতি অবহেলা অনেকটা প্রচ্ছন্ন হলেও প্রবল।

এখনও যদি প্রতিবেশীর ঘর থেকে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে তখন গৃহকর্ত্রীর প্রথম প্রশ্ন থাকে – ছেলে হয়েছে নাকি মেয়ে? ফর্সা নাকি কালো? আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই। মেয়েদের বেলায় ফর্সা হওয়া ফরজ। আর যদি ফর্সা না হয় তাহলে তার আশু ভবিষ্যতের করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করে মা-বাবা শিউরে ওঠেন। ভবিষ্যতে মেয়ে বিয়ে দিতে যৌতুক লাগবে এবং যৌতুকের অর্থ সঞ্চয়ের বয়স এবং মেয়ের বয়স সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়। আবার, কোনো কালো চামড়ার পুরুষ যদি সৌভাগ্যক্রমে সাদা চামড়ার কোনো মেয়েকে বিয়ে করার গৌরব অর্জন করতে পারে, তাহলে সমাজের মানুষের উপমা ব্যবহারের ঘনঘটা দেখে যে কেউ মূর্ছা যেতে পারে। এহ! বাদুড়ের গলায় মুক্তোর মালা কিংবা কাকের গলায় সীতাহার – ইত্যাদি বলে ঐ পুরুষকে বিদ্রুপবাণে জর্জরিত করা হয়।

এমনকি আমাদের এই অঞ্চলের অনেক প্রবাদ-প্রবচন কিংবা গানেও বর্ণবাদ প্রকট। উদাহরণস্বরূপ : নদীর জল ঘোলাও ভালো, জাতের মেয়ে কালোও ভালো। এই প্রবাদটি বিশ্লেষণ করলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে কালোর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিতে তাকানো হয়েছে। মূলত এই প্রবাদটিতে কালো মেয়েকে চূড়ান্তভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। উঁচু বংশের মেয়ে কালো হলে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু নিচু বংশের মেয়ে কালো হলেই সমস্যা! অর্থাৎ জাত ভালো হলে কালো আলো ছড়াবে অন্যথায় কালো মানেই অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অনন্য নিদর্শন  ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘দানখণ্ডের ১৩ নম্বর পদে কৃষ্ণের প্রতি রাধার অভিব্যক্তি নিম্নরূপ :

কাল হাণ্ডির ভাত না খাঁও।

কাল মেঘের ছায়া নাহিঁ জাওঁ।

কালিনী রাতি মোঁ প্রদীপ জালিআঁ পোহাঁও।

কাল গাইর ক্ষীর নাহিঁ খাও।

কাল কাজল নয়নে না লওঁ।

কাল কাহ্নাঞিঁ তোক বড় ডরাওঁ।।

অর্থ : কালো হাঁড়ির ভাত খাই না, কালো মেঘের ছায়াতে যাই না, কালো (অর্থাৎ আঁধার) রাত্রি প্রদীপ জ্বেলে কাটাই। কালো গরুর ক্ষীর খাই না, কালো কাজল চোখে নিই না। কালো কানাই তোকে অত্যন্ত ভয় করি।

উপর্যুক্ত ছন্দোবদ্ধ ছত্রগুলো অতীত সাহিত্যে কালোদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিভঙ্গির একটি উদাহরণ মাত্র। আমাদের এই অঞ্চলে, এরূপ অমূল্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশক সাহিত্য অনেকটাই সহজলভ্য। সাহিত্য হলো সমাজের প্রতিচ্ছবি। জীবনের প্রতিচ্ছবি। সময়ের প্রতিচ্ছবি এবং সমাজের প্রতিচ্ছবি। সমাজ বিনির্মাণে এবং সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সাহিত্যের ভূমিকা বর্ণনাতীত। সেই সাহিত্যেও বর্ণবাদ প্রকট।

কবি-সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্টিকর্মে নায়িকাদের রূপ-লাবণ্যের বর্ণনা দিয়ে থাকেন। সাধারণত নায়িকার বদনকে দুধে-আলতা মাখানো রঙের সাথে, নায়িকার পদযুগলকে ধবধবে শাদা বকের পালকের সাথে তুলনা করে থাকেন। তদ্রূপ কবিদের পথ অনুসরণ করে প্রণয়ী তার প্রণয়িনীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ফর্সা গোত্রের প্রাণীর সাথে তুলনা করে থাকে। এবং এরূপ তুলনাই স্বতসিদ্ধ রীতি। এর ব্যতিক্রম (যেমন: কাক কিংবা হারগিলার সাথে তুলনা) ঘটলেই অনেক সময় সম্পর্কের তাঁর কেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

পুঁজিবাদ এবং বর্ণবাদের সম্পর্ক অনেকটা প্রণয়ী-প্রণয়িনীর সম্পর্কের মতো। কালোকে হীনমন্যতা রোগে আক্রান্ত করাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না পুঁজিবাদ। কারণ বর্তমানে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য বৃহৎ বাজারের প্রয়োজন হয়। আর এই বৃহৎ বাজার সৃষ্টির জন্য কালোর মধ্যে হীনমন্যতার ইনজেকশন পুশ করা হয়। কালোর সম্মানহানিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আমাদের বর্বর মানসিকতার গণমাধ্যমগুলো। এমনকি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বর্ণবাদ চর্চায় সর্বোচ্চ সম্মানী পাওয়ার দাবিদার।

কালো কিংবা ধলো সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত। তাই ধলো-কালোতে বিভেদ সৃষ্টি মানেই সৃষ্টিকর্তার অপমান। মানুষের আয়ত্ত্বের মধ্যে যা থাকে অর্থাৎ মানুষ যা নিজের প্রচেষ্টায় অর্জন করে সেটি হচ্ছে তার চারিত্রিক গুণাবলি। তাই সুস্থ পৃথিবী গড়তে মানবীয় গুণের কদর এবং পরিচর্যা করা আবশ্যক।

মুন্নি আক্তার সুমি

প্রভাষক, বাংলা

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ