সম্ + √ধা + ই = সন্ধি।
সম্ অর্থ একসঙ্গে, √ধা অর্থ ধারণ করা। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ধ্বনিকে একসঙ্গে ধারণ করা বা ধরে রাখাই সন্ধি। অর্থাৎ সন্ধি হচ্ছে ধ্বনিসন্ধি (phonic union) । ব্যাকরণমতে, সন্ধি ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।
পৃথিবীর সব ভাষাতেই সন্ধির ব্যবহার আছে এবং ভাষাভেদে সন্ধির নিয়মেও ভিন্নতা আছে। সংস্কৃত ভাষায় বহু সন্ধিজাত শব্দ আছে এবং সন্ধির বহু নিয়মও আছে। সে-তুলনায় বাংলা ভাষায় সন্ধির ব্যবহার সীমিত।
আমরা এখানে বাংলা সন্ধি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নেব।
বাংলা সন্ধি ২ প্রকার− স্বরসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধি।
কতিপয় বাংলা সন্ধি সংস্কৃত সন্ধির অনুরূপ। যথা:
১. স্বরসন্ধি
অ + অ = আ
পোস্ট + অফিস = পোস্টাফিস।
অ + আ = আ:
গোল + আলু = গোলালু
ঘাম + আছি = ঘামাচি
চাষ + আ = চাষা
বড় + আই = বড়াই
রকম + আরি = রকমারি
বাচ + আল = বাচাল
মাত (মত্ত) + আল = মাতাল
ঠাকুর + আলি = ঠাকুরালি।
অ + এ = এ:
আধ + এক = আধেক
এক + এক = একেক (− দিন)
কত + এক = কতেক
চার + এক = চারেক
পাঁচ + এক = পাঁচেক
তিল + এক = তিলেক
দশ + এক = দশেক
যত + এক = যতেক
শত + এক = শতেক।
তদ্রূপ: কয় + এক = কয়েক, দুই + এক = দুয়েক। উইক-এন্ড = উইকেন্ড।
আ + আ = আ:
ঢাকা + আই = ঢাকাই
মিঠা + আই = মিঠাই
মালা + আই = মালাই
জেঠা + আমি = জেঠামি/জ্যাঠামি
ভাঙ্গা + আনি = ভাঙ্গানি > ভাঙানি
রাঙ্গা + আনি = রাঙ্গানি > রাঙানি
সুতা + আর = সুতার > সুতোর
কাঁসা + আরি = কাঁসারি
জুয়া + আরি = জুয়ারি> জুয়াড়ি
মিতা + আলি = মিতালি
সোনা + আলি = সোনালি
রুপা + আলি = রুপালি
সুতা + আলি = সুতালি > সুতলি।
আ + ই = ই:
গোলা + ই = গুলি
ছাতা + ই = ছাতি
ছোরা + ই = ছুরি
যা + ইচ্ছে + তাই = যাচ্ছেতাই।
আ + এ = আ:
ঢাকা + এর = ঢাকার
খুলনা + এর = খুলনার
পদ্মা + এর = পদ্মার
মেঘনা + এর = মেঘনার।
টীকা: চায়ের বাগান = চা-বাগান। (৬ষ্ঠী তৎপুরুষ)
ই + ই = ই :
খাসি + ইয়া = খাসিয়া
ভাই + ইয়া = ভাইয়া
ঘড়ি + ইয়াল = ঘড়িয়াল > ঘড়েল
লাঠি + ইয়াল = লাঠিয়াল > লেঠেল।
ই + এ = ই:
কুড়ি + এক = কুড়িক
কোটি + এক = কোটিক
খানি + এক = খানিক > খানেক (মাস-)
গুটি + এক = গুটিক।
এ + আ = এ:
কুঁড়ে + আমি = কুঁড়েমি
ছেলে + আমি = ছেলেমি।
২. ব্যঞ্জনসন্ধি
পূর্বে বর্গীয় ১ম বর্ণ এবং পরে বর্গীয় ৩য়/৪র্থ/৫ম বর্ণ অথবা অন্তঃস্থ বর্ণ (য র ল ব) অথবা উষ্মবর্ণ (হ) থাকলে, বর্গীয় ১ম বর্ণের স্থানে ঐ বর্গের ৩য় বর্ণ হয়। যেমন:
এক + গুণ = এগ্গুণ, ক> গ
ডাক + ঘর = ডাগ্ঘর, ক> গ
শাক + ভাত =শাগ্ভাত, ক> গ
টক + গন্ধ = টগ্ গন্ধ, ক> গ
বট + গাছ = বড্গাছ, ট > ড
নাত + বৌ = নাদবৌ, ত > দ
রাত + দিন = রাদ্দিন, ত > দ
আড়ত + দার = আড়তদার > আড়দ্দার, ত > দ
মজুত + দার = মজুতদার > মজুদ্দার, ত > দ
পাঁচ + জন = পাঁজ্জন, চ > জ।
উল্লেখ্য, স্বরলোপ, স্বরসঙ্গতি, সমীভবন, ঘোষীভবন, অল্পপ্রাণীকরণ, দ্বিত্ব ব্যঞ্জন প্রভৃতি বাংলা সন্ধির মূল ভিত্তি।
নিচে সূত্রসহ উদাহরণ দেওয়া হলো:
১. স্বরলোপ
মধ্যস্বর লোপ:
অ-লোপ
বড় + আপু = বড়াপু
বড় + দাদা = বড়্দা
মেজ + দাদা = মেজদা
সেজ + দাদা = সেজদা
ছোট + দাদা = ছোড়্দা
√বস্ + অতি = বসতি > বস্তি
√বাট্ + অনা = বাটনা।
টীকা: বড় + আপা = বড়্’পা। পিক-আপ = পিকাপ, মেক-আপ = মেকাপ।
আ-লোপ
কাঁচা + কলা = কাঁচকলা
কোথা + থেকে = কোত্থেকে
খুড়া + তুত = খুড়তুত > খুড়তুতো
জেঠা + তুত = জেঠতুত > জেঠতুতো
ঘোড়া + দৌড় = ঘোড়দৌড়
টাকা + শাল = টাকশাল
ভরা + দুপুর = ভরদুপুর
ধোপা + খোলা = ধুপখোলা (− মাঠ)।
ই-লোপ
জাতি + ভাই = জাতভাই
নাতি + বৌ = নাতবৌ
পানি + তা = পান্তা (-ভাত)
পানি + সা = পানসা > পানসে
পাখি + মারা = পাখমারা
বেশি + কম = বেশকম
মিশি + কালো = মিশকালো
সারি + বন্দী = সারবন্দী
মাসি + তুত = মাসতুত > মাসতুতো
পিসি + তুত = পিসতুত > পিসতুতো।
উ-লোপ
উঁচু + কপালি = উঁচ্কপালি।
এ-লোপ
গাছে + পাকা = গাছপাকা (− আম)
ঘরে + পাতা = ঘরপাতা (− দই)
পথে + চলা = পথচলা
বাক্সে + বন্দী = বাক্সবন্দী
পেটে + ব্যথা = পেটব্যথা
পিছে + মোড়া = পিছমোড়া
মনে + গড়া = মনগড়া
মনে + মরা = মনমরা
তালে + কানা = তালকানা
রাতে + কানা = রাতকানা।
মধ্য ও অন্ত্য স্বরলোপ:
কাটা + ছাঁটা = কাটাছাঁটা > কাটছাঁট
ঝাড়া + মোছা = ঝাড়ামোছা > ঝাড়মোছ
দেখা + শুনা = দেখাশুনা > দেখশুন
ভরা + পুরা = ভরাপুরা > ভরপুর
রাখা + ঢাকা = রাখাঢাকা > রাখঢাক
হেলা + দোলা = হেলাদোলা > হেলদোল।
তদ্রূপ: খোদার বান্দা = খোদাবন্দ।
২. স্বরাগম
মধ্য স্বরাগম
বাগ + চা = বাগিচা
√বহ্ + তা = বহতা।
৩. স্বরসঙ্গতি:
আ + উ = উ:
আব্বা + উ = আব্বু
আম্মা + উ = আম্মু
কাকা + উ = কাকু
জেঠা + উ = জেঠু
কালা + উ = কালু
ধলা + উ = ধলু
খোকা + উ = খুকু
খালা + উ = খালু
দাদা + উ = দাদু (-বাড়ি)
নানা + উ = নানু (-বাড়ি)
মামা + উ = মামু (গ্রাম্য শব্দ)।
তদ্রূপ: নিন্দার্থে বা স্নেহার্থে− মোটা + উ = মটু, ছোট + উ = ছটু, পাতালা + উ = পাতলু, লম্বা + উ = লম্বু, রাধা + উ = রাধু, হাঁদা + উ = হাঁদু।
অনি (প্রত্যয়) > নি:
√খাট্ + অনি = খাটনি > খাটনি (খাটা-)
√ঘুট্ + অনি = ঘুটনি > ঘুটনি (ডাল-)
√চাল্ + অনি = চালনি > চালনি
√চাঁচ্ + অনি = চাঁচনি > চাঁচনি
√চাট্ + অনি = চাটনি > চাটনি
√ছাক্ + অনি = ছাঁকনি > ছাঁকনি
√ঢাক্ + অনি = ঢাকনি > ঢাকনি।
অনি (প্রত্যয়) > উনি:
√আঁট্ + অনি = আঁটনি > আঁটুনি (বজ্র-)
√কাঁদ্ + অনি = কাঁদনি > কাঁদুনি (ছিঁচ-)
√কাঁপ্ + অনি = কাঁপনি > কাঁপুনি
√কুর্ + অনি = কুরনি > কুরুনি
√গাঁথ্ + অনি = গাঁথনি > গাঁথুনি
√খাট্ + অনি = খাটনি > খাটুনি
√চির্ + অনি = চিরনি > চিরুনি
√নাচ্ + অনি = নাচনি > নাচুনি (− বুড়ি)
√ধুক্ + অনি = ধুকনি > ধুকুনি (ধুক-)
√ধুচ্ + অনি = ধুচনি > ধুচুনি
√রাঁধ্ + অনি = রাঁধনি > রাঁধুনি।
আনি (প্রত্যয়) > উনি:
√উড়্ + আনি = উড়ানি > উড়ুনি (− বুড়ি)
√কুড়্ + আনি = কুড়ানি > কুড়ুনি (পাতা-)
√চুব্ + আনি = চুবানি > চুবুনি
√ঝাঁক্ + আনি = ঝাঁকানি > ঝাঁকুনি
√ঝিম্ + আনি = ঝিমানি > ঝিমুনি
√ফুট্ + আনি = ফুটানি > ফুটুনি।
টীকা: √ছট্ফট্ + আনি = ছটফটানি, √জ্বাল্ + আনি =জ্বালানি, √হাঁপ্ + আনি = হাঁপানি।
আরি > উরি:
√ডুব + আরি = ডুবারি > ডুবুরি
√ধুন + আরি = ধুনারি > ধুনুরি।
আচি > উচি
√ধুন্ + আচি = ধুনাচি > ধুনুচি।
উলি (প্রত্যয়) > লি
আধ + উলি = আধুলি > আধলি
সুতা + উলি = সুতুলি > সুতলি।
৪. সমীভবন
কর + তাল = করতাল > কত্তাল
হর + তাল = হরতাল > হত্তাল
দুর + তোর = দুত্তোর
√কাঁদ্ + না = কান্না
√রাঁধ্ + না = রান্না
চার + শ = চারশ > চাশ্শ।
৫. ঘোষীভবন
অত + দিন = অদ্দিন
এত + দিন = এদ্দিন/অ্যাদ্দিন
কত + দিন = কদ্দিন
যত + দিন = যদ্দিন
অত + দূর = অদ্দুর
এত + দূর = এদ্দুর/অ্যাদ্দুর
কত + দূর = কদ্দুর
যত + দূর = যদ্দুর।
৬. দ্বিত্ব ব্যঞ্জন
আর + না = আন্না
আলুর + দম = আলু্দ্দম
ঘোড়ার + ডিম = ঘোড়াড্ডিম
ঘর + করনা = ঘরকন্না
চার + টি = চাট্টি (-খানি)
চোর + নি = চুন্নি (শাঁক-)
জুয়া + চোর = জুচ্চোর > জোচ্চোর
বদ + জাত = বজ্জাত
বি + ছিরি =বিচ্ছিরি
হত + ছাড়া = হতচ্ছাড়া।
৭. অল্পপ্রাণীকরণ
আধ + লা = আধলা > আদলা
আধ + উলি = আধুলি > আদুলি
কাঠ + রা = কাঠরা > কাটরা (বড় −)
বখা + টিয়া = বখাটিয়া > বখাটে > বকাটে
ভেড়ি + বাঁধ = ভেড়িবাঁধ > বেড়িবাঁধ
সমঝ + দার = সমঝদার > সমজদার
সুখ + তলা = সুখতলা > সুকতলা
সোয়া + লাখিয়া = সোয়ালাখিয়া > শোলাকিয়া (− ইদগাঁ)।
৮. অন্তর্হতি
ঘোড়ার + গাড়ি = ঘোড়াগাড়ি
ঠাকুর + মা = ঠাকুরমা > ঠাকুমা
পাট + কাঠি = পাটকাঠি > পাকাটি
বংশ + শাল = বংশশাল > বংশাল (− থানা)
বাপ + জান = বাপজান > বাজান
মামার + বাড়ি = মামাবাড়ি
শাহ + মাহমুদ = শা-মামুদ
সিংহ + দরজা = সিংদরজা।
সন্ধি শব্দগঠনের একটি পদ্ধতি। এর সাহায্যে আমরা বাংলা শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারি। তবে শ্রুতিকটু ও অর্থবিভ্রাট সৃষ্টি হয়, এমন ক্ষেত্রে সন্ধি প্রযোজ্য নয়। যেমন: কচু + আদা + আলু = কচাদালু, বক + কচ্ছপ = বকচ্ছপ, দুইশ + তিন = দুই-সতিন।
মমিনুল হক
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা