WhatsApp Image 2022-06-28 at 12.12.02 PM

বাংলা সন্ধি

সম্ + √ধা + ই = সন্ধি।

সম্ অর্থ একসঙ্গে, √ধা অর্থ ধারণ করা। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ধ্বনিকে একসঙ্গে ধারণ করা বা ধরে রাখাই সন্ধি। অর্থাৎ সন্ধি হচ্ছে ধ্বনিসন্ধি (phonic union) । ব্যাকরণমতে, সন্ধি ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

পৃথিবীর সব ভাষাতেই সন্ধির ব্যবহার আছে এবং ভাষাভেদে সন্ধির নিয়মেও ভিন্নতা আছে। সংস্কৃত ভাষায় বহু সন্ধিজাত শব্দ আছে এবং সন্ধির বহু নিয়মও আছে। সে-তুলনায় বাংলা ভাষায় সন্ধির ব্যবহার সীমিত।

আমরা এখানে বাংলা সন্ধি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নেব।

বাংলা সন্ধি ২ প্রকার− স্বরসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধি।

কতিপয় বাংলা সন্ধি সংস্কৃত সন্ধির অনুরূপ। যথা:

. স্বরসন্ধি

অ + অ = আ

পোস্ট + অফিস = পোস্টাফিস।

অ + আ = আ:

গোল + আলু = গোলালু

ঘাম + আছি = ঘামাচি

চাষ + আ = চাষা

বড় + আই = বড়াই

রকম + আরি = রকমারি

বাচ + আল = বাচাল

মাত (মত্ত) + আল = মাতাল

ঠাকুর + আলি = ঠাকুরালি।

অ + এ = এ:

আধ + এক = আধেক

এক + এক = একেক (− দিন)

কত + এক = কতেক

চার + এক = চারেক

পাঁচ + এক = পাঁচেক

তিল + এক = তিলেক

দশ + এক = দশেক

যত + এক = যতেক

শত + এক = শতেক।

তদ্রূপ: কয় + এক = কয়েক, দুই + এক = দুয়েক। উইক-এন্ড = উইকেন্ড।

আ + আ = আ:

ঢাকা + আই = ঢাকাই

মিঠা + আই = মিঠাই

মালা + আই = মালাই

জেঠা + আমি = জেঠামি/জ্যাঠামি

ভাঙ্গা + আনি = ভাঙ্গানি > ভাঙানি

রাঙ্গা + আনি = রাঙ্গানি > রাঙানি

সুতা + আর = সুতার > সুতোর

কাঁসা + আরি = কাঁসারি

জুয়া + আরি = জুয়ারি> জুয়াড়ি

মিতা + আলি = মিতালি

সোনা + আলি = সোনালি

রুপা + আলি = রুপালি

সুতা + আলি = সুতালি > সুতলি।

আ + ই = ই:

গোলা + ই = গুলি

ছাতা + ই = ছাতি

ছোরা + ই = ছুরি

যা + ইচ্ছে + তাই = যাচ্ছেতাই।

আ + এ = আ:

ঢাকা + এর = ঢাকার

খুলনা + এর = খুলনার

পদ্মা + এর = পদ্মার

মেঘনা + এর = মেঘনার।

টীকা: চায়ের বাগান = চা-বাগান। (৬ষ্ঠী তৎপুরুষ)

ই + ই = ই :

খাসি + ইয়া = খাসিয়া

ভাই + ইয়া = ভাইয়া

ঘড়ি + ইয়াল = ঘড়িয়াল > ঘড়েল

লাঠি + ইয়াল = লাঠিয়াল > লেঠেল।

ই + এ = ই:

কুড়ি + এক = কুড়িক

কোটি + এক = কোটিক

খানি + এক = খানিক > খানেক (মাস-)

গুটি + এক = গুটিক।

এ + আ = এ:

কুঁড়ে + আমি = কুঁড়েমি

ছেলে + আমি = ছেলেমি।

. ব্যঞ্জনসন্ধি

পূর্বে বর্গীয় ১ম বর্ণ এবং পরে বর্গীয় ৩য়/৪র্থ/৫ম বর্ণ অথবা অন্তঃস্থ বর্ণ (য র ল ব) অথবা উষ্মবর্ণ (হ) থাকলে, বর্গীয় ১ম বর্ণের স্থানে ঐ বর্গের ৩য় বর্ণ হয়। যেমন:

এক + গুণ = এগ্গুণ, ক> গ

ডাক + ঘর = ডাগ্ঘর, ক> গ

শাক + ভাত =শাগ্ভাত, ক> গ

টক + গন্ধ = টগ্ গন্ধ, ক> গ

বট + গাছ = বড্গাছ, ট > ড

নাত + বৌ = নাদবৌ, ত > দ

রাত + দিন = রাদ্দিন, ত > দ

আড়ত + দার = আড়তদার > আড়দ্দার, ত > দ

মজুত + দার = মজুতদার > মজুদ্দার, ত > দ

পাঁচ + জন = পাঁজ্জন, চ > জ।

উল্লেখ্য, স্বরলোপ, স্বরসঙ্গতি, সমীভবন, ঘোষীভবন, অল্পপ্রাণীকরণ, দ্বিত্ব ব্যঞ্জন প্রভৃতি বাংলা সন্ধির মূল ভিত্তি।

নিচে সূত্রসহ উদাহরণ দেওয়া হলো:

. স্বরলোপ

মধ্যস্বর লোপ:

অ-লোপ

বড় + আপু = বড়াপু

বড় + দাদা = বড়্দা

মেজ + দাদা = মেজদা

সেজ + দাদা = সেজদা

ছোট + দাদা = ছোড়্দা

√বস্ + অতি = বসতি > বস্তি

√বাট্ + অনা = বাটনা। 

টীকা: বড় + আপা = বড়্’পা। পিক-আপ = পিকাপ, মেক-আপ = মেকাপ।

আ-লোপ  

কাঁচা + কলা = কাঁচকলা

কোথা + থেকে = কোত্থেকে

খুড়া + তুত = খুড়তুত > খুড়তুতো

জেঠা + তুত = জেঠতুত > জেঠতুতো

ঘোড়া + দৌড় = ঘোড়দৌড়

টাকা + শাল = টাকশাল

ভরা + দুপুর = ভরদুপুর

ধোপা + খোলা = ধুপখোলা (− মাঠ)।

ই-লোপ

জাতি + ভাই = জাতভাই

নাতি + বৌ = নাতবৌ

পানি + তা = পান্তা (-ভাত)

পানি + সা = পানসা > পানসে

পাখি + মারা = পাখমারা

বেশি + কম = বেশকম

মিশি + কালো = মিশকালো

সারি + বন্দী = সারবন্দী

মাসি + তুত = মাসতুত > মাসতুতো

পিসি + তুত = পিসতুত > পিসতুতো।

উ-লোপ

উঁচু + কপালি = উঁচ্কপালি।

এ-লোপ

গাছে + পাকা = গাছপাকা (− আম)

ঘরে + পাতা = ঘরপাতা (− দই)

পথে + চলা = পথচলা

বাক্সে + বন্দী = বাক্সবন্দী

পেটে + ব্যথা = পেটব্যথা

পিছে + মোড়া = পিছমোড়া

মনে + গড়া = মনগড়া

মনে + মরা = মনমরা

তালে + কানা = তালকানা

রাতে + কানা = রাতকানা।

মধ্য ও অন্ত্য স্বরলোপ:

কাটা + ছাঁটা = কাটাছাঁটা > কাটছাঁট

ঝাড়া + মোছা = ঝাড়ামোছা > ঝাড়মোছ

দেখা + শুনা = দেখাশুনা > দেখশুন

ভরা + পুরা = ভরাপুরা > ভরপুর

রাখা + ঢাকা = রাখাঢাকা > রাখঢাক

হেলা + দোলা = হেলাদোলা > হেলদোল।

তদ্রূপ: খোদার বান্দা = খোদাবন্দ।

২. স্বরাগম

মধ্য স্বরাগম

বাগ + চা = বাগিচা

√বহ্ + তা = বহতা।

. স্বরসঙ্গতি:

আ + উ = উ:

আব্বা + উ = আব্বু

আম্মা + উ = আম্মু

কাকা + উ = কাকু

জেঠা + উ = জেঠু

কালা + উ = কালু

ধলা + উ = ধলু

খোকা + উ = খুকু

খালা + উ = খালু

দাদা + উ = দাদু (-বাড়ি)

নানা + উ = নানু (-বাড়ি)

মামা + উ = মামু (গ্রাম্য শব্দ)। 

তদ্রূপ: নিন্দার্থে বা স্নেহার্থে− মোটা + উ = মটু, ছোট + উ = ছটু, পাতালা + উ = পাতলু, লম্বা + উ = লম্বু, রাধা + উ = রাধু, হাঁদা + উ = হাঁদু।

অনি (প্রত্যয়) > নি:

√খাট্ + অনি = খাটনি > খাটনি (খাটা-)

√ঘুট্ + অনি = ঘুটনি > ঘুটনি (ডাল-)

√চাল্ + অনি = চালনি > চালনি

√চাঁচ্ + অনি = চাঁচনি > চাঁচনি

√চাট্ + অনি = চাটনি > চাটনি

√ছাক্ + অনি = ছাঁকনি > ছাঁকনি

√ঢাক্ + অনি = ঢাকনি > ঢাকনি।

অনি (প্রত্যয়) > উনি:

√আঁট্ + অনি = আঁটনি > আঁটুনি (বজ্র-)

√কাঁদ্ + অনি = কাঁদনি > কাঁদুনি (ছিঁচ-)

√কাঁপ্ + অনি = কাঁপনি > কাঁপুনি

√কুর্ + অনি = কুরনি > কুরুনি

√গাঁথ্ + অনি = গাঁথনি > গাঁথুনি

√খাট্ + অনি = খাটনি > খাটুনি

√চির্ + অনি = চিরনি > চিরুনি

√নাচ্ + অনি = নাচনি > নাচুনি (− বুড়ি)

√ধুক্ + অনি = ধুকনি > ধুকুনি (ধুক-)

√ধুচ্ + অনি = ধুচনি > ধুচুনি

√রাঁধ্ + অনি = রাঁধনি > রাঁধুনি।

আনি (প্রত্যয়) > উনি:

√উড়্ + আনি = উড়ানি > উড়ুনি (− বুড়ি)

√কুড়্ + আনি = কুড়ানি > কুড়ুনি (পাতা-)

√চুব্ + আনি = চুবানি > চুবুনি

√ঝাঁক্ + আনি = ঝাঁকানি > ঝাঁকুনি

√ঝিম্ + আনি = ঝিমানি > ঝিমুনি

√ফুট্ + আনি = ফুটানি > ফুটুনি।

টীকা: √ছট্ফট্ + আনি = ছটফটানি, √জ্বাল্ + আনি =জ্বালানি, √হাঁপ্ + আনি = হাঁপানি।

আরি > উরি:

√ডুব + আরি = ডুবারি > ডুবুরি

√ধুন + আরি = ধুনারি > ধুনুরি।

আচি > উচি 

√ধুন্ + আচি = ধুনাচি > ধুনুচি।

উলি (প্রত্যয়) > লি

আধ + উলি = আধুলি > আধলি

সুতা + উলি = সুতুলি > সুতলি।

. সমীভবন

কর + তাল = করতাল > কত্তাল

হর + তাল = হরতাল > হত্তাল

দুর + তোর = দুত্তোর

√কাঁদ্ + না = কান্না

√রাঁধ্ + না = রান্না

চার + শ = চারশ > চাশ্শ।

. ঘোষীভবন

অত + দিন = অদ্দিন

এত + দিন = এদ্দিন/অ্যাদ্দিন

কত + দিন = কদ্দিন

যত + দিন = যদ্দিন

অত + দূর = অদ্দুর

এত + দূর = এদ্দুর/অ্যাদ্দুর

কত + দূর = কদ্দুর

যত + দূর = যদ্দুর।

. দ্বিত্ব ব্যঞ্জন

আর + না = আন্না

আলুর + দম = আলু্দ্দম

ঘোড়ার + ডিম = ঘোড়াড্ডিম

ঘর + করনা = ঘরকন্না

চার + টি = চাট্টি (-খানি)

চোর + নি = চুন্নি (শাঁক-)

জুয়া + চোর = জুচ্চোর > জোচ্চোর

বদ + জাত = বজ্জাত

বি + ছিরি =বিচ্ছিরি

হত + ছাড়া = হতচ্ছাড়া।

. অল্পপ্রাণীকরণ

আধ + লা = আধলা > আদলা

আধ + উলি = আধুলি > আদুলি

কাঠ + রা = কাঠরা > কাটরা (বড় −)

বখা + টিয়া = বখাটিয়া > বখাটে > বকাটে

ভেড়ি + বাঁধ = ভেড়িবাঁধ > বেড়িবাঁধ

সমঝ + দার = সমঝদার > সমজদার

সুখ + তলা = সুখতলা > সুকতলা

সোয়া + লাখিয়া = সোয়ালাখিয়া > শোলাকিয়া (− ইদগাঁ)।

৮. অন্তর্হতি

ঘোড়ার + গাড়ি = ঘোড়াগাড়ি

ঠাকুর + মা = ঠাকুরমা > ঠাকুমা

পাট + কাঠি = পাটকাঠি > পাকাটি

বংশ + শাল = বংশশাল > বংশাল (− থানা)

বাপ + জান = বাপজান > বাজান

মামার + বাড়ি = মামাবাড়ি

শাহ + মাহমুদ = শা-মামুদ

সিংহ + দরজা = সিংদরজা।

সন্ধি শব্দগঠনের একটি পদ্ধতি। এর সাহায্যে আমরা বাংলা শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারি। তবে শ্রুতিকটু ও অর্থবিভ্রাট সৃষ্টি হয়, এমন ক্ষেত্রে সন্ধি প্রযোজ্য নয়। যেমন: কচু + আদা + আলু = কচাদালু, বক + কচ্ছপ = বকচ্ছপ, দুইশ + তিন = দুই-সতিন।  

মমিনুল হক

সহকারী অধ্যাপক, বাংলা

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

Tags: No tags

Comments are closed.