WhatsApp Image 2022-08-31 at 11.32.35 AM

বাঙালির চোখে সাদা-কালো

দেশে দেশে কালে কালে সাদার মাহাত্ম্য ধ্বনিত হয়েছে। সাদা মানেই সুন্দর। সাদা মানেই স্বর্গীয় কোনোকিছু। সাদা মানেই চোখ ধাঁধানো মন ভোলানো অপার রহস্যাবৃত মানসিক প্রশান্তির নিবাস। অপরদিকে কালো মানেই অন্ধকার। সব মুছে দেওয়ার কারিগর। কালো মানেই বিদঘুটে কোনোকিছু। কালো মানেই দুর্যোগের আভাস। কালো মানেই অভিশপ্ত নগরীর ধ্বংসপ্রাপ্ত ইটের গাঁথুনি থেকে ভেসে আসা ক্রন্দনরতার চিৎকার।

সাদার প্রতি দুর্বলতা এবং কালোর প্রতি প্রচ্ছন্ন ঘৃণা স্থান বিশেষে প্রকাশ্যে ঘৃণা আমাদের চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। আমাদের পোষা বিড়াল কিংবা কুকুরটির বহিরাবরণ যদি সাদা কিংবা সাদা গোত্রীয় রঙের হয়ে থাকে তাহলে পোষ্যগুলোর প্রতি আমাদের ভালোবাসাও জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। আবার, কোনো প্রতিষ্ঠানের কিংবা রাষ্ট্রের অনুষ্ঠানের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, সাদা কবুতর ওড়ানো হচ্ছে কারণ সাদা কবুতরকে শান্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সাদা কবুতরের পরিবর্তে যদি কালো কবুতর ওড়ানো হতো তাহলে কী পৃথিবী অশান্তির ভাগাড় হতো! এতো গেলো মামুলি পোষা প্রাণীর কথা। চামড়ায় মেলানিনের আধিক্যের দরুন মানুষের পৃথিবীতে মানুষের দ্বারা মানুষই সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের শিকার হয়।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ শোষণ, নিষ্পেষণ এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছে চামড়ার রঙের তারতম্যের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বর্বরতার ইতিহাস অনেক পুরাতন। সাধারণত কৃষ্ণাঙ্গদের নিগ্রো, আফ্রিকান কাফ্রি, বর্বর, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করতে আমরা অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর এই স্বাচ্ছন্দ্য মূলত ছন্দ-তাল-লয় পায় আমাদের শৈশব থেকেই। সাধারণত, শৈশব থেকেই আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় যে, ফর্সা মানেই সুন্দর এবং কালো মানেই ভয়ঙ্কর এবং কুৎসিত। কালোকে পূর্বেই একটি ছাঁচে ফেলে দেওয়া হয় এবং এই ছাঁচেই কালো সম্পর্কিত সমুদয় আদিম ধারণা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেড়ে ওঠে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মস্তিষ্কের এই ছাঁচই যত্নের সাথে লালন করা হয়। ইউরোপে কৃষ্ণাঙ্গের প্রতি শ্বেতাঙ্গের ঘৃণা-বিদ্রূপ-অবহেলা অনেকটাই প্রকাশ্যে ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশে কালোর প্রতি অবহেলা অনেকটা প্রচ্ছন্ন হলেও প্রবল।

এখনও যদি প্রতিবেশীর ঘর থেকে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে তখন গৃহকর্ত্রীর প্রথম প্রশ্ন থাকে – ছেলে হয়েছে নাকি মেয়ে? ফর্সা নাকি কালো? আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই। মেয়েদের বেলায় ফর্সা হওয়া ফরজ। আর যদি ফর্সা না হয় তাহলে তার আশু ভবিষ্যতের করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করে মা-বাবা শিউরে ওঠেন। ভবিষ্যতে মেয়ে বিয়ে দিতে যৌতুক লাগবে এবং যৌতুকের অর্থ সঞ্চয়ের বয়স এবং মেয়ের বয়স সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়। আবার, কোনো কালো চামড়ার পুরুষ যদি সৌভাগ্যক্রমে সাদা চামড়ার কোনো মেয়েকে বিয়ে করার গৌরব অর্জন করতে পারে, তাহলে সমাজের মানুষের উপমা ব্যবহারের ঘনঘটা দেখে যে কেউ মূর্ছা যেতে পারে। এহ! বাদুড়ের গলায় মুক্তোর মালা কিংবা কাকের গলায় সীতাহার – ইত্যাদি বলে ঐ পুরুষকে বিদ্রুপবাণে জর্জরিত করা হয়।

এমনকি আমাদের এই অঞ্চলের অনেক প্রবাদ-প্রবচন কিংবা গানেও বর্ণবাদ প্রকট। উদাহরণস্বরূপ : নদীর জল ঘোলাও ভালো, জাতের মেয়ে কালোও ভালো। এই প্রবাদটি বিশ্লেষণ করলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে কালোর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিতে তাকানো হয়েছে। মূলত এই প্রবাদটিতে কালো মেয়েকে চূড়ান্তভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। উঁচু বংশের মেয়ে কালো হলে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু নিচু বংশের মেয়ে কালো হলেই সমস্যা! অর্থাৎ জাত ভালো হলে কালো আলো ছড়াবে অন্যথায় কালো মানেই অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অনন্য নিদর্শন  ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘দানখণ্ডের ১৩ নম্বর পদে কৃষ্ণের প্রতি রাধার অভিব্যক্তি নিম্নরূপ :

কাল হাণ্ডির ভাত না খাঁও।

কাল মেঘের ছায়া নাহিঁ জাওঁ।

কালিনী রাতি মোঁ প্রদীপ জালিআঁ পোহাঁও।

কাল গাইর ক্ষীর নাহিঁ খাও।

কাল কাজল নয়নে না লওঁ।

কাল কাহ্নাঞিঁ তোক বড় ডরাওঁ।।

অর্থ : কালো হাঁড়ির ভাত খাই না, কালো মেঘের ছায়াতে যাই না, কালো (অর্থাৎ আঁধার) রাত্রি প্রদীপ জ্বেলে কাটাই। কালো গরুর ক্ষীর খাই না, কালো কাজল চোখে নিই না। কালো কানাই তোকে অত্যন্ত ভয় করি।

উপর্যুক্ত ছন্দোবদ্ধ ছত্রগুলো অতীত সাহিত্যে কালোদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিভঙ্গির একটি উদাহরণ মাত্র। আমাদের এই অঞ্চলে, এরূপ অমূল্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশক সাহিত্য অনেকটাই সহজলভ্য। সাহিত্য হলো সমাজের প্রতিচ্ছবি। জীবনের প্রতিচ্ছবি। সময়ের প্রতিচ্ছবি এবং সমাজের প্রতিচ্ছবি। সমাজ বিনির্মাণে এবং সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সাহিত্যের ভূমিকা বর্ণনাতীত। সেই সাহিত্যেও বর্ণবাদ প্রকট।

কবি-সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্টিকর্মে নায়িকাদের রূপ-লাবণ্যের বর্ণনা দিয়ে থাকেন। সাধারণত নায়িকার বদনকে দুধে-আলতা মাখানো রঙের সাথে, নায়িকার পদযুগলকে ধবধবে শাদা বকের পালকের সাথে তুলনা করে থাকেন। তদ্রূপ কবিদের পথ অনুসরণ করে প্রণয়ী তার প্রণয়িনীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ফর্সা গোত্রের প্রাণীর সাথে তুলনা করে থাকে। এবং এরূপ তুলনাই স্বতসিদ্ধ রীতি। এর ব্যতিক্রম (যেমন: কাক কিংবা হারগিলার সাথে তুলনা) ঘটলেই অনেক সময় সম্পর্কের তাঁর কেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

পুঁজিবাদ এবং বর্ণবাদের সম্পর্ক অনেকটা প্রণয়ী-প্রণয়িনীর সম্পর্কের মতো। কালোকে হীনমন্যতা রোগে আক্রান্ত করাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না পুঁজিবাদ। কারণ বর্তমানে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য বৃহৎ বাজারের প্রয়োজন হয়। আর এই বৃহৎ বাজার সৃষ্টির জন্য কালোর মধ্যে হীনমন্যতার ইনজেকশন পুশ করা হয়। কালোর সম্মানহানিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আমাদের বর্বর মানসিকতার গণমাধ্যমগুলো। এমনকি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বর্ণবাদ চর্চায় সর্বোচ্চ সম্মানী পাওয়ার দাবিদার।

কালো কিংবা ধলো সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত। তাই ধলো-কালোতে বিভেদ সৃষ্টি মানেই সৃষ্টিকর্তার অপমান। মানুষের আয়ত্ত্বের মধ্যে যা থাকে অর্থাৎ মানুষ যা নিজের প্রচেষ্টায় অর্জন করে সেটি হচ্ছে তার চারিত্রিক গুণাবলি। তাই সুস্থ পৃথিবী গড়তে মানবীয় গুণের কদর এবং পরিচর্যা করা আবশ্যক।

মুন্নি আক্তার সুমি

প্রভাষক, বাংলা

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

Tags: No tags

Comments are closed.