 (1)-1745993317.webp)
নেতিবাচকতার ফাঁদ: মস্তিষ্ক, চিন্তার গঠন ও ভবিষ্যৎ ...
- Apr 26, 2025
আমরা প্রায়শই একটা কথা শুনে অভ্যস্ত, “বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।” অথচ এই বিজ্ঞানের কল্যাণেই আমরা আয়েশি জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বিজ্ঞান ব্যাটার যদি আমাদের মতো বাকশক্তি থাকতো তবে নিশ্চয়ই সে প্রতিবাদ করতো। বলা হয়ে থাকে কম্পিউটার হচ্ছে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার। আবার অনেকেই বলবে সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার বিদ্যুৎ। কারণ, বিদ্যুৎ ছাড়া বাকি সবকিছু অকেজো। কিন্তু আমার কাছে এসবকিছুকে ছাপিয়ে পৃথিবীর বিস্ময়কর আবিষ্কারের নাম ‘ভাষা’। ভাষা শুধু কয়েকটি শব্দ নয়, হৃদয় অনুভবের বহিঃপ্রকাশ নয়, নেহাৎ যোগাযোগের মাধ্যমও নয়। ভাষায় লুকিয়ে আছে সময়। অতীত-বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কোলাহলই ভাষা। যখন শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য যোজনা করে হৃদয় অনুভবের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে না তখনও সেই অপ্রকাশিতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভাষা: নিজের সাথে নিজের কথোপকথন। ভাষায় শব্দের ব্যবহারে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয় আবার এই শব্দের অপব্যবহারেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। ভাষা কখনো কাঁদায়, কখনো হাসায় আবার কখনো নিঃশব্দকে বরণ করতে শেখায়। ধ্বনি, শব্দ ও বাক্যের সম্মিলনেই কেবল ভাষা, ভাষা হয়ে ওঠে না। আমার কাছে মনে হয় নৈঃশব্দ্যেরও ভাষা আছে যেমন থাকে নিকষ কালো অন্ধকার রাতের, যেমন থাকে নীরবে প্রবহমান নদীর, যেমন থাকে স্থির হয়ে থাকা প্রকাণ্ড পাহাড়ের অথবা যেমন থাকে মৃত্তিকার স্তরে স্তরে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মাটি খুঁড়ে কালের ভাষা আবিষ্কার করেন। হাজার হাজার বছর পূর্বের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর আবিষ্কৃত ফসিল শুধু কী সেই প্রাণীরই ফসিল? না, আমার কাছে মনে হয়– ফসিল যতটা প্রাণীর ঠিক ততোটা সময়েরও। জাদুঘরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কম-বেশি সবারই থাকে। কারো কাছে জাদুঘর পরিদর্শন নেহাৎ সময়ের অপচয়, আবার কারো কাছে এটি অতীতের সাথে কথোপকথনের একটি উত্তম ব্যবস্থা। অর্থাৎ মূল পার্থক্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। বোঝার সুবিধার্থে ভাষাকে যদি সাহিত্যের মতো দুইভাগে ভাগ করা হয় তাহলে বোধহয় কিঞ্চিৎ সহজিকরণ হয়। ধরা যাক, ভাষা দুই প্রকার: (ক) তন্ময় ভাষা (খ) মন্ময় ভাষা। বর্ণ, শব্দ এবং বাক্যের সাহায্যে যা কিছু ব্যক্ত হয় তাই-ই তন্ময় ভাষা। আর ব্যক্ত করার পরও যা কিছু অব্যক্ত থাকে তাই-ই মন্ময় ভাষা। মানুষের হাসি,কান্না, ক্রোধ, ক্ষোভ, ঘৃণা, হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভাষায়। তদ্রূপ ব্যক্তিভেদে কবি-সাহিত্যিকদের ভাষায়ও বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। সময়ের বিবর্তনে এই চর্যাপদের ভাষাই আমাদের কাছে আজ অপরিচিত। আবার, মধ্যযুগের সাহিত্যিক নিদর্শন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলী। অথচ ভাষার ব্যবহারে কতটা পার্থক্য বিদ্যমান। অর্থাৎ সময় এবং ব্যক্তিভেদে ভাষার পরিবর্তনশীলতা লক্ষনীয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের ভাষার সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের ভাষার মিল নেই আবার জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষার সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার ভাষার কোনো মিল নেই। এই যে, সময় এবং ব্যক্তিভেদে ভাষার যে বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান– এটাই ভাষার সৌন্দর্য। এতোক্ষণ মনুষ্য জাতির ভাষা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো এবার আসা যাক পক্ষীকুল এবং প্রাণীকুল প্রসঙ্গে। আমাদের অতিপরিচিত পাখি: কোকিল এবং কাক। সবাই কোকিলের কুহুতানই শুনতে চায়, কাকের কা কা রব কেউ শুনতে চায় না। কাকের ভাষাই কা কা। তাই, অন্যের মন রক্ষার দায় কিংবা সক্ষমতা কোনোটাই কাকের নেই। আবার, বিড়ালের মিউ মিউ কিংবা কুকুরের ঘেউ ঘেউ — কোন ভাষা হৃদয়ে কাব্যিক অনুরণন জাগায় সেই তর্কে না জড়ানোই ভালো। গরুর হাম্বা কিংবা মোরগের কুকুরুক্কু — কোনোটাই মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে গীত নয়। এগুলো এসকল প্রাণীকুলের সহজাত প্রবৃত্তির অন্তর্ভুক্ত। কারণ, আপন ভাষায় কথা কইতে কে না ভালোবাসে! তাই সবাইকে সবার ভাষায় কথা বলতে দেওয়া উচিৎ। অবশ্য উচিৎ-অনুচিৎ বিবেচনা করেই ভাষার প্রয়োগ করা সমীচীন। যা কিছু প্রয়োগের অন্তরালে থাকবে সেগুলো মন্ময় ভাষার আওতাধীন। আদিম গুহাবাসী মানুষের বাগযন্ত্রের আওয়াজ কালের পরিক্রমায় আজ প্রায় ৭,১৬৮ টি ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। ভাষার থেকে বিস্ময়কর আবিষ্কার মতান্তরে সৃষ্টি আর কিইবা হতে পারে!
মুন্নি আক্তার সুমি
প্রভাষক (বাংলা)
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, ঢাকা