রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ – ১৯৪১) বাংলা ছোটগল্পের জনক এবং বাংলা ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তিনি শ-খানেক ছোটগল্প লিখে বাংলা ছোটগল্প-সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ ও শিখরস্পর্শী। সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে, তিনি বিশ্বসেরা গল্পলেখকদের পঙক্তিভুক্ত হবার যোগ্য। সে-হিসেবে মার্কিন গল্পলেখক অ্যাডগার অ্যালেন পো (১৮০৯ – ১৮৪৯), ফরাসি গল্পলেখক গি দ্য মোপাসাঁ (১৮৫০- ১৮৯৩) ও রুশ গল্পলেখক আন্তন চেখভের (১৮৬০ – ১৯০৪) সঙ্গে তাঁর নামও স্মরণীয় হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘ভিখারিণী’ (১৮৭৪ খ্রি.) । তাঁর প্রথম সার্থক ছোটগল্প
‘দেনা-পাওনা’ (১৮৯১)। গল্পটি কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য-সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ (১৮৯১) পত্রিকায় মুদ্রিত হয় এবং পরে যথাক্রমে ‘গল্পসপ্তক’ও গল্পগুচ্ছে (৩য় খণ্ড) সংগৃহীত হয়। এর দুই দশক পরে তিনি লিখেছেন ‘হৈমন্তী’ (১৯১৪) ও ‘অপরিচিতা’ (১৯১৪)। এগুলো প্রমথ চৌধুরী-সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’(১৯১৪) পত্রিকায় মুদ্রিত হয় এবং পরে গল্পগুচ্ছে সংগৃহীত হয়।
এখানে আলোচ্য তিনটিই পণপ্রথাকেন্দ্রিক ছোটগল্প। বিষয়গত ঐক্য থাকলেও এগুলোতে আছে নানা পার্থক্য ও বৈচিত্র্য। তাছাড়া এগুলোতে আছে গল্পলেখকের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ছায়া। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে গল্পগুলোর একটা আলাদা তাৎপর্য রয়েছে।
‘দেনা-পাওনা’গল্পের গল্পকথক লেখক স্বয়ং। কিন্তু ‘হৈমন্তী’ও ‘অপরিচিতা’গল্পে গল্পবর্ণনা করেছে যথাক্রমে অপু ও অনুপম। এরা গল্পের নায়ক এবং গল্পকথক।
‘অপরিচিতা’গল্পে অনুপম গল্পের শুরুতেই বর্ণনা দিচ্ছে, ‘আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যের হিসাবে বড়, না গুণের হিসাবে। তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে। ইহা সেই ফুলের মতো যাহার বুকের উপরে ভ্রমর আসিয়া বসিয়াছিল, এবং সেই পদক্ষেপের ইতিহাস তাহার জীবনের মাঝখানে ফলের মতো গুটি ধরিয়া উঠিয়াছে।’
‘হৈমন্তী’গল্পে অপু বর্ণনা দিচ্ছে, ‘আমি ছিলাম বর, সুতরাং বিবাহ সম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল। আমার কাজ আমি করিয়াছি, এফ. এ. পাস করিয়া বৃত্তি পাইয়াছি। তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ, বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষ ঘন ঘন বিচলিত হইয়া উঠিল।’
‘দেনা-পাওনা’বালিকাবধূ নিরুপমা (নিরু) ও তার ঋণগ্রস্ত অসহায় বাবা রামসুন্দর মিত্রের গল্প। গল্পটির নাম-নির্বাচনে চরিত্র নয়, পণপ্রথাই প্রাধান্য পেয়েছে। ‘হৈমন্তী’ গল্পের প্রধান আকর্ষণ হৈমন্তী। তার বাবা গৌরীশঙ্করবাবু ঋষিতুল্য। অপুর ভাষ্যমতে, হৈমন্তী এযুগের সীতা আর সে হচ্ছে রামচন্দ্র। অপুর খেদোক্তি, ‘বুকের রক্ত দিয়া আমাকে যে একদিন দ্বিতীয় সীতা বিসর্জনের কাহিনী লিখিতে হইবে সে-কথা কে জানিত।’
‘অপরিচিতা’গল্পের প্রধান আকর্ষণ কল্যাণী। সে-ই (কল্যাণীই) অনুপম ও তার তীর্থযাত্রী মায়ের কাছে অপরিচিতা ও রহস্যময়ী এক তরুণী, যে রেলগাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য চোখের সামনে এসে ধরা দিয়েও অনেকখানি অধরা থেকে গেছে। অনুপমের ভাবনায় সে‘অর্ধেক রমণী’ ও ‘অর্ধেক কল্পনা’, এক স্বপ্নকন্যা (Dream Girl)।
অনুপমের ভাষ্যমতে, ‘এই স্থুল অংশটাও (পণ) বিবাহের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’ আমাদের ধারণা, দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। গুরুত্বহীন ও গৌণ অংশ হচ্ছে নববধূটি। উল্লেখযোগ্য যে, এগুলো গল্পলেখকের সমকালীন হিন্দুসমাজের যে সমাজ বিবেক ও মনুষ্যত্বশূন্য পরিচয় বহন করছে। আরো উল্লেখযোগ্য যে, গল্পলেখক তাঁর বড় ও মেজ মেয়েকে (রানি ও অতসী) পণসহ বাল্যবিবাহ দিয়েছেন এবং এদের বিবাহিত জীবন ছিল স্বল্পস্থায়ী ও দুর্বিষহ। এদেরই প্রতিচ্ছবি যেন নিরুপমা (নিরু) ও হৈমন্তী (হৈম)। এরা পণপ্রথার নির্মম বলি। কিন্তু ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণী ও তার বাবা শম্ভুনাথ সেন সতর্ক ও পরিণামদর্শী। এরা শ্বশুরগৃহে বধূ-নিগ্রহ থেকে মুক্তির একটা সরল পথ খুঁজে নিয়েছে। এরা নতুন যুগের বার্তাবহ।
এটা সুবিদিত যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিসম্ভার বিশাল। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান অবলম্বন ছিল সাধুভাষা। আলোচ্য গল্পগুলোতেও সাধুভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে।‘দেনা-পাওনা’ গল্পের বর্ণনাভঙ্গি সংযত ও যথাযথ।‘হৈমন্তী’ও‘অপরিচিতা’গল্পের বর্ণনাভঙ্গি কাব্যধর্মী। আমাদের ধারণা, আলোচ্য তিনটি ছোটগল্পের মধ্যে ‘হৈমন্তী -ই শ্রেষ্ঠ।
মমিনুল হক
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা