‘সমাস’ একটি দ্বিমুখী শব্দ (Palindrome word)। অর্থাৎ বাম থেকে ডানে বা ডান থেকে বামে− যেদিকেই যাই− ‘সমাস’ শব্দটি অপরিবর্তিত থাকে। তদ্রূপ, দরদ, জমজ, নতুন, বাহবা।
ব্যাকরণমতে, সম্ + অস্ + অ (ঘঞ্) = সমাস। এর অর্থ ‘সংক্ষেপণ’। অর্থাৎ বাক্যস্থ অর্থসম্বন্ধযুক্ত একাধিক পদের একীভূত বা সংক্ষিপ্ত রূপই সমাস। এটি মূলত সংস্কৃত ভাষার নিয়ম, যা বাংলা ভাষায়ও প্রচলিত আছে।
কয়েকটি উদাহরণ দিই :
মহান যে রাজা, তিনি তীর্থে যাবেন।
মহারাজ তীর্থে যাবেন।
অথবা,
আমার হাতে পরার ঘড়িটি দামি।
আমার হাতঘড়িটি দামি।
অথবা,
তিন বাহু (ভুজ) দ্বারা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র অঙ্কন করো।
ত্রিভুজ অঙ্কন করো।
পূর্বোক্ত তিনটি বাক্যই সমাসের উদাহরণ। এখানে অর্থ ঠিক রেখে বাক্যস্থ পদসমূহকে একীভূত বা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এখানে ‘মহারাজ’ সাধারণ কর্মধারয়, ‘হাতঘড়ি’ মধ্যপদলোপী কর্মধারয় ও ‘ত্রিভুজ’ দ্বিগু/কর্মধারয় সমাস।
আরও উদাহরণ−
এগুলো গাছে পাকা আম।
এগুলো গাছপাকা আম।
অথবা,
লোকটি জন্ম থেকে অন্ধ ।
লোকটি জন্মান্ধ।
অথবা,
মেয়েটি এক অধিক দশ শ্রেণিতে পড়ছে।
মেয়েটি একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে।
এখানে লক্ষনীয় যে, সমাসবদ্ধ পদ বাক্যকে সরল, শ্রুতিমধুর ও সংক্ষিপ্ত করেছে। ভাষাদক্ষতা অর্জনে এর প্রয়োজন ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সমাস (compound word) আর বাক্য সংকোচন (sentence contraction)-এর মধ্যে সাদৃশ্য বা পার্থক্য কী? আমাদের ধারণা, দুটোই বাক্য সংক্ষেপণ। তবে এদের গঠনপদ্ধতি আলাদা। সমাসের ব্যাসবাক্যে পূর্বপদ ও পরপদ থাকে এবং সমাসের প্রকারভেদ থাকে, যা বাক্য সংকোচনে থাকে না।
নিচের তালিকাটি লক্ষ করা যাক :
সমাস | বাক্য সংকোচন |
চতুঃ (চার) অঙ্গের সমষ্টি = চতুরঙ্গ দুঃ (কঠিন) যে পাচ্য = দুষ্পাচ্য পূর্বে ভূত = ভূতপূর্ব ন (নয়) অতি দীর্ঘ = নাতিদীর্ঘ | অশ্ব, রথ, হস্তী ও পদাতিক সৈন্যের সমষ্টি – চতুরঙ্গ যা সহজে পরিপাক হয় না – দুষ্পাচ্য যা পূর্বে ছিল, এখন নেই − ভূতপূর্ব যা খুব দীর্ঘ নয় − নাতিদীর্ঘ |
এখানে ‘চতুরঙ্গ’ দ্বিগু, ‘দুষ্পাচ্য’ কর্মধারয়, ‘ভূতপূর্ব’ ৭মী তৎপুরুষ ও ‘নাতিদীর্ঘ’ নঞর্থক তৎপুরুষ সমাস।
উল্লেখ্য, সমাস হচ্ছে অর্থের মিলন আর সন্ধি হচ্ছে পার্শ্বস্থ বা সংলগ্ন দুটি ধ্বনি/বর্ণের মিলন। সমাস ও সন্ধির গঠনপদ্ধতিও আলাদা। যথা−
সমাস | সন্ধি |
জায়া ও পতি = দম্পতি | জায়া> দম্ + পতি = দম্পতি |
কটু যে উক্তি = কটূক্তি | কটু + উক্তি = কটূক্তি |
স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল অক্ষর = স্বর্ণাক্ষর | স্বর্ণ + অক্ষর = স্বর্ণাক্ষর |
পুষ্প দ্বারা অঞ্জলি = পুষ্পাঞ্জলি | পুষ্প + অঞ্জলি = পুষ্পাঞ্জলি |
অহ্নের অপরভাগ = অপরাহ্ণ | অপর + অহ্ন = অপরাহ্ণ |
এখানে ‘দম্পতি’ দ্বন্দ্ব, ‘কটূক্তি’ সাধারণ কর্মধারয়, ‘স্বর্ণাক্ষর’ মধ্যপদলোপী কর্মধারয়, ‘পুষ্পাঞ্জলি’ ৩য়া তৎপুরুষ ও ‘অপরাহ্ণ’ ৬ষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস।
সংস্কৃত ব্যাকরণমতে, সমাস প্রধানত ৬ প্রকার। যথা : দ্বন্দ্ব, দ্বিগু, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, অব্যয়ীভাব ও বহুব্রীহি।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, দ্বিগু ও কর্মধারয় একই শ্রেণিভুক্ত। অর্থাৎ এগুলোতে পূর্বপদে বিশেষণ ও পরপদের অর্থপ্রধান্য থাকে। তা ছাড়া ‘অব্যয়ীভাব’ উপসর্গের নিয়মে সিদ্ধ। সেহেতু বাংলা ব্যাকরণমতে, সমাস প্রধানত ৪ প্রকার। যথা− দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ ও বহুব্রীহি।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সমাসবদ্ধ পদগঠনের মূল ভিত্তি হচ্ছে দুটি পদ− পূর্বপদ ও পরপদ। কোন পদের অর্থ প্রধান− পূর্বপদ না পরপদ− সেটিই সমাস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
পদের অর্থপ্রাধান্য অনুযায়ী সমাসের শ্রেণিবিন্যাস নিম্নরূপ :
সমাস | পূর্বপদ | পরপদ | অন্যপদ |
দ্বন্দ্ব | Ö | Ö | |
দ্বিগু | Ö | ||
কর্মধারয় | Ö | ||
তৎপুরুষ | Ö | ||
অব্যয়ীভাব | Ö | ||
বহুব্রীহি | Ö |
উল্লেখ্য, একই পদের বিভিন্ন প্রকার সমাস হতে পারে। আরও উল্লেখ্য, ব্যাসবাক্য অনুযায়ী সমাসের নাম নির্ধারিত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাসবাক্যটি শুদ্ধ বা যথার্থ হওয়া বাঞ্ছনীয়। যথা−
ব্যাসবাক্য = সমস্তপদ | সমাসের নাম |
মুখ পদ্মের ন্যায় = মুখপদ্ম মুখ রূপ পদ্ম = মুখপদ্ম | উপমিত কর্মধারয় রূপক কর্মধারয় |
মোমের বাতি = মোমবাতি মোম নির্মিত বাতি = মোমবাতি | ৬ষ্ঠী তৎপুরুষ মধ্যপদলোপী কর্মধারয় |
তেল দ্বারা ভাজা = তেলেভাজা তেলে ভাজা = তেলেভাজা | ৩য়া তৎপুরুষ অলুক তৎপুরুষ |
ঢেঁকি দ্বারা ছাঁটা = ঢেঁকিছাঁটা ঢেঁকিতে ছাঁটা = ঢেঁকিছাঁটা | ৩য়া তৎপুরুষ ৭মী তৎপুরুষ |
ন (নেই) ওয়ারিশ = বেওয়ারিশ ওয়ারিশ নেই যার = বেওয়ারিশ | নঞর্থক তৎপুরুষ নঞর্থক বহুব্রীহি |
উল্লেখ্য, দুধ ও ভাত = দুধভাত (দ্বন্দ্ব) শুদ্ধ নয়। দুধ মিশ্রিত ভাত = দুধভাত (মধ্যপদলোপী কর্মধারয়) শুদ্ধ। তদ্রূপ, দুধসাগু। আরও উল্লেখ্য, রাজার পুত্র = রাজপুত্র (৬ষ্ঠী তৎপুরুষ) শুদ্ধ। কিন্তু রাজার হংস = রাজহংস (৬ষ্ঠী তৎপুরুষ) শুদ্ধ নয়। হংসের রাজা = রাজহংস (৬ষ্ঠী তৎপুরষ) শুদ্ধ। তদ্রূপ, রাজপথ। এখানে প্রথম ‘রাজা’ (King) এবং দ্বিতীয় ‘রাজা’ শ্রেষ্ঠ/বড় অর্থ বোঝাচ্ছে।
কয়েকটি বিশেষ নিয়ম :
১. সমস্তপদ পুরুষবাচক থাকলেও ব্যাসবাক্যে স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যবহৃত হয়। যথা :
কুকুরীর ছানা = কুকুরছানা, ছাগীর দুগ্ধ = ছাগদুগ্ধ, হংসীর ডিম্ব = হংসডিম্ব । তদ্রূপ− সুন্দরীবৃক্ষের বন =
সুন্দরবন। এগুলো তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ। আরও উদাহরণ – মহতী যে কীর্তি = মহাকীর্তি (সাধারণ কর্মধারয়),
পঞ্চ নদীর সমষ্টি = পঞ্চনদ (দ্বিগু/কর্মধারয়)।
২. সমস্তপদে ‘ক’/কা’/‘কদ’ থাকলেও ব্যাসবাক্যে ‘কু’ ব্যবহৃত হয়। যথা :
কু যে অর্থ = কদর্থ, কু যে পুরুষ = কাপুরুষ, কু যে আকার = কদাকার।
৩. পঙ্কে জন্মে যা = পঙ্কজ (পদ্ম), জলে জন্মে যা = জলজ (− উদ্ভিদ)। কিন্তু ফল দান কারে যা– ‘ফলদ’। অর্থাৎ
‘ফলজ’ নয়− ‘ফলদ’ বৃক্ষ শুদ্ধ।