লালসালু: একটি মাজারের কাহিনী:Daffodil International College Blog(Mominul Huq)

লালসালু: একটি মাজারের কাহিনী

পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের (১৯০৩ – ১৯৭৬) ‘কবর’ কবিতাটি ‘রাখালী’ (১৯২৭) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এটি গল্পনির্ভর একটি করুণ রসাত্মক কবিতা। কবিতার শ্রেণি-বিচারে এটি শোক কবিতা (Elegy)। মুনীর চৌধুরীর (১৯২৫ – ১৯৭১) ‘কবর’ (রচনাকাল ১৯৫৩) একাঙ্কিকা। এটি ১৯৫২-র ভাষা সংগ্রামের আবহে রচিত। তৃতীয়টি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এর (১৯২২ – ১৯৭১) উপন্যাস ‘লালসালু’ (১৯৪৮)। এরও বিষয়বস্তু একটি কবর বা মাজার।
‘লালসালু’তে বর্ণিত মহব্বতনগর শস্য সমৃদ্ধ প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। গ্রামটিতে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার আলো পৌঁছেনি। মজিদ মৌলবি হঠাৎ একদিন ওই গ্রামে এসে নাটকীয়ভাবে একটি মাজার প্রতিষ্ঠা করল। এরপর সে গ্রামীণ জীবনের মঞ্চে একজন ধর্মীয় নেতা তথা দক্ষ অভিনেতারূপে আবির্ভূত হলো। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন। মজিদ মৌলবির গতিবিধি, গোপন অভিপ্রায় ও কার্যকলাপ তাকে আর দশজন গ্রামবাসী থেকে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট করে তুলেছে। লেখকের মতে – ‘মাজারটি তার শক্তির মূল।’ অর্থাৎ সে ‘মাজারের মুখপাত্র’ বা খাদেম। মাজারটিকে কেন্দ্র করেই তার উত্থান ও শ্রীবৃদ্ধি। নইলে মহব্বতনগর গ্রামে সে একজন দরিদ্র ও ছিন্নমূল বহিরাগত (Outsider) মাত্র।
‘কবর’ ও ‘মাজার’ আরবি শব্দ, কিন্তু দুয়ের মাজেজা আলাদা। কবর সাধারণ সমাধি- যার বিশেষ যত্ন হয় না। কিন্তু মাজার হচ্ছে পির-দরবেশের সমাধি- যার অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী থাকে। মাজার পবিত্র ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ স্থান। সেহেতু প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মাজার লালসালুতে ঢাকা থাকে। আলোচ্য বইটিতে কখনো ‘কবর’ (কার কবর এটা?), কখনো ‘মাজার’ (মাছের পিঠের মতো মাজার) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের ধারণা, এর মধ্যে একটা বৈপরীত্য (Paradox) আছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে অসংখ্য মাজার দেখা যায়। কিন্তু সে-সব মাজারে কি ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষিত হয়? সে-সবের কয়টি আসল এবং কয়টি নকল মাজার?
‘লালসালু’তে মজিদ মৌলবির মুখে গ্রামবাসী যে স্বপ্নবৃত্তান্ত (মাজার প্রতিষ্ঠার গল্প) শুনেছে, তা আষাঢ়ে গল্পমাত্র। যে পির আসলে মরেনি, কবরে জেন্দা আছে- সে হচ্ছে ‘মোদাচ্ছের’ পির। গ্রামবাসী যে মোদাচ্ছের (জীবিত) পিরের মাজারে এসে যাবতীয় বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি কামনা করেছে, তা শিরক্। ইসলাম ধর্মমতে, মুফতি ফতোয়া দেওয়ার যোগ্য। কিন্তু মজিদ মৌলবি (মক্তবের মৌলবি) যে ফতোয়াবাজি করেছে, তা সম্পূর্ণরূপে বেদাত। স্ত্রীলোকের সন্তান হওয়া না-হওয়া সম্পর্কে মজিদ মৌলবি যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা ধর্মবিরোধী। ইসলাম ধর্মমতে, জেকের এক প্রকার এবাদত। কিন্তু মজিদ মৌলবি মাজার প্রাঙ্গণে ভক্ত-মুরিদ সহ যে জেকের অনুষ্ঠান করেছে, তা সম্পূর্ণরূপে বেদাত। মূলকথা হচ্ছে মজিদ মৌলবির কাছে ধর্ম স্বার্থসিদ্ধির একটা মোক্ষম অস্ত্র। ধর্মীয় দৃষ্টিতে সে পথভ্রষ্ট ও মোনাফেক। সে ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েছে। সে মিথ্যাচার ও প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। তার ঈমান-আকিদা খুবই দুর্বল। কিন্তু সরল ও ধর্মভীরু গ্রামবাসী তাকে ধোঁকাবাজ ভাবেনি বা তাকে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করেনি।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কেন ‘লালসালু’ লিখেছেন? ইসলাম ধর্মমতে, কবর বা মাজার জেয়ারত করা সুন্নত, কিন্তু মাজারপূজা শিরক্ ও বেদাত। অর্থাৎ মাজারপূজা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অথচ বিশ্বাসী ব্যক্তিমাত্রই জানেন, মাজার পবিত্র স্থান। এখানে স্মরণীয় যে, ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রেটির সৃষ্টি। এর মাত্র এক বছর পর ‘লালসালু’ রচিত। পাকিস্তান যে ‘ফাঁকিস্তান – ধর্মীয় নিপীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনার লীলাক্ষেত্র, আলোচ্য বইটিতে সে- ইঙ্গিতই করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘অহিংসা’ (১৯৪১), ‘হুযুর কেবলা’ ও ‘দেবতার জন্ম’ রচনা-তিনটির কথা উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮ – ১৯৫৬) লেখা উপন্যাস, দ্বিতীয়টি ও তৃতীয়টি যথাক্রমে আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮ – ১৯৭৮) ও শিবরাম চক্রবর্তীর (১৯০৩ – ১৯৮০) লেখা ছোটগল্প। এগুলোতেও কপট ধর্মগুরুদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। 

বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত গোষ্ঠি ‘লালসালু’কে ‘বিতর্কিত’ মনে করেন। তাদের মতে, বইটিতে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে। আমাদের ধারণা, অভিযোগটি ভিত্তিহীন। ‘লালসালু’তে মজিদ মৌলবি একজন কপট ধর্মগুরু, কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ গ্রামবাসীদের কাছে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করেননি। তিনি পিরপ্রথা ও মাজারপ্রথার ত্রুটি ও অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেছেন। তিনি অন্ধ বিশ্বাসী নন, বরং একজন সত্যনিষ্ঠ ও মানবহিতৈষী লেখক। তবে কেউ চাইলে ‘লালসালু’তে কার্ল মার্কসের (১৮১৮ – ১৮৮৩) দূরবর্তী ছায়াও খুঁজে পাবেন।

-মমিনুল হক

সহকারি অধ্যাপক, বাংলা

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

Comments are closed.