প্রত্যয়যুক্ত শব্দ ও বানান

প্রত্যয়যুক্ত শব্দ ও বানান

উপসর্গ ও প্রত্যয় বাংলা শব্দগঠনের দুটি পদ্ধতি।

ব্যাকরণমতে, ধাতু ও শব্দের পূর্বে উপসর্গ এবং পরে প্রত্যয় যুক্ত হয়। যথা: স (উপসর্গ) + মূল = সমূল, মূল + সহ (প্রত্যয়) = মূলসহ। সাধারণত একই শব্দে যুগপৎ উপসর্গ ও প্রত্যয় যুক্ত হয় না। সেহেতু ‘সমূলসহ’ অশুদ্ধ। তদ্রূপ, আ + কাঙ্ক্ষা = ‘আকাঙ্ক্ষা’ এবং কাঙ্ক্ষা + -ইত = ‘কাঙ্ক্ষিত’ শুদ্ধ । কিন্তু ‘আকাঙ্ক্ষিত’ অশুদ্ধ। আ + শঙ্কা = ‘আশঙ্কা’ এবং শঙ্কা + -ইত = ‘শঙ্কিত’ শুদ্ধ । কিন্তু ‘আশঙ্কিত’ অশুদ্ধ। আবার ধাতু ও শব্দে যুগপৎ দুটি প্রত্যয় যুক্ত হয় না। সেহেতু দরিদ্র + -য (ষ্ণ্য) = ‘দারিদ্র্য’ এবং দরিদ্র + -তা = ‘দরিদ্রতা’ শুদ্ধ। কিন্তু ‘দারিদ্র্যতা’ অশুদ্ধ। তদ্রূপ, ‘দৈন্য’/‘দীনতা’ শুদ্ধ। কিন্তু ‘দৈন্যতা’ অশুদ্ধ। ‘সাফল্য‘/‘সফলতা’ শুদ্ধ। কিন্তু ‘সাফল্যতা’ অশুদ্ধ।  

আরও উদাহরণ−

ভুল বানানশুদ্ধরূপ *
উৎকর্ষতা
ঔজ্জ্বল্যতা
কার্পণ্যতা
চাঞ্চল্যতা
বাহুল্যতা 
বৈচিত্র্যতা
বৈশিষ্ট্যতা
বৈষম্যতা
যাথার্থ্যতা
সখ্যতা
স্বাতন্ত্র্যতা
সাদৃশ্যতা
সামঞ্জস্যতা
সারল্যতা
সৌজন্যতা
উৎকৃষ্ট + য (ষ্ণ্য) = উৎকর্ষ
উজ্জ্বল + য = ঔজ্জ্বল্য
কৃপণ + য  = কার্পণ্য
চঞ্চল + য = চাঞ্চল্য
বহুল + য = বাহুল্য
বিচত্র + য = বৈচিত্র্য
বিশিষ্ট + য = বৈশিষ্ট্য
বিষম + য = বৈষম্য
যথার্থ + য = যাথার্থ্য
সখা + য = সখ্য
স্বতন্ত্র + য += স্বাতন্ত্র্য
সদৃশ + য = সাদৃশ্য
সমঞ্জস + য = সামঞ্জস্য
সরল + য = সারল্য
সুজন + য = সৌজন্য

*এখানে শুধু য (ষ্ণ্য)-যুক্ত বানানগুলো নির্দেশিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, ‘কৃচ্ছ্রতা’ নয়, ‘কৃচ্ছ্র’ (-সাধন) শুদ্ধ। ‘বদান্যতা’ নয়, বদ্ + আন্য = ‘বদান্য’ শুদ্ধ।  আরও উল্লেখ্য, পাগল + আ + টিয়া = পাগলাটিয়া > ‘পাগলাটে’ শুদ্ধ, প্রমাণ + য + তা = ‘প্রামাণ্যতা’ শুদ্ধ। নৌ + য + তা = ‘নাব্যতা’  শুদ্ধ। হৃদ + য + তা = ‘হৃদ্যতা’ শুদ্ধ। এখানে দুটি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে শব্দ গঠিত হয়েছে। তবে এমন উদাহরণ বিরল।  

আধুনিক বানানবিধিমতে, রেফ-এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব (Double use) হয় না। যথা : অর্চ্চনা > অর্চনা, মূর্চ্ছনা > মূর্ছনা, মার্জ্জনা > মার্জনা, অপূর্ব্ব > অপূর্ব, সর্ব্বোচ্চ > সর্বোচ্চ, কর্ত্তব্য > কর্তব্য, গৃহকর্ত্তা > গৃহকর্তা, ভাবমূর্ত্তি > ভাবমূর্তি, দুর্দ্দিন > দুর্দিন, মর্ম্মবস্তু >মর্মবস্তু।   

আরও উদাহরণ−

ভুল বানানশুদ্ধরূপ
আচার্য্য
আশ্চর্য্য
আহার্য্য
ঐশ্বর্য্য
ঔদার্য্যতা 
কার্য্য
গাম্ভীর্য্যতা
চাতুর্য্যতা
চৌর্য্য
ধৈর্য্য
ধার্য্য
পরিহার্য্য
প্রাচুর্য্যতা
ব্যবহার্য্য
বিচার্য্য
স্বীকার্য্য
স্থৈর্য্য
সূর্য্য
শৌর্য্য
সৌন্দর্য্য
মাধুর্য্য
আ + √চর্ + য (ষ্ণ্য)= আচার্য 
আ + চর্য্য = আশ্চর্য
আহার + য = আহার্য
ঈশ্বর + য = ঐশ্বর্য
উদার + য = ঔদার্য
√কৃ + য  = কার্য
গম্ভীর + য = গাম্ভীর্য
চতুর + য = চাতুর্য
চোর + য = চৌর্য
ধীর + য = ধৈর্য
√ধৃ + য = ধার্য
পরিহার + য = পরিহার্য
প্রচুর + য = প্রাচুর্য
ব্যবহার + য = ব্যবহার্য
বিচার + য = বিচার্য
স্বীকার + য = স্বীকার্য
স্থির + য = স্থৈর্য
√সৃ + য = সূর্য
শূর + য = শৌর্য
সুন্দর + য = সৌন্দর্য
মধুর + য = মাধুর্য

উল্লেখ্য, সমর্থ + য = ‘সামর্থ্য’ শুদ্ধ। তদ্রূপ, দীর্ঘ + য = ‘দৈর্ঘ্য’, মূর্ধন্ + য =‘মূর্ধন্য’ শুদ্ধ। আরও উল্লেখ্য, শ্রদ্ধা + অর্ঘ্য = ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য’ শুদ্ধ।

প্রত্যয়ের আরও কয়েকটি নিয়ম:

০১. -ত্ব (তৃচ্)

শব্দের শেষে ঈ-কার থাকলে এবং পরে ত্ব (প্রত্যয়) যুক্ত হলে ঈ > ই হয়। যথা:

একাকী + -ত্ব = একাকিত্ব, কৃতী + -ত্ব = কৃতিত্ব, দায়ী + -ত্ব = দায়িত্ব, স্থায়ী + -ত্ব = স্থায়ীত্ব, মন্ত্রী + -ত্ব = মন্ত্রিত্ব, স্বামী + -ত্ব = স্বামিত্ব।

কিন্তু স্ত্রীবাচক শব্দে ঈ-কার অক্ষুণ্ণ থাকে। যথা:

কুমারীত্ব, নারীত্ব, ছাত্রীত্ব।

উল্লেখ্য, ‘মহত্ব’ নয়− মহৎ + -ত্ব = ‘মহত্ত্ব’ শুদ্ধ। তদ্রূপ, ‘তত্ব’ নয়− তৎ + -ত্ব = ‘তত্ত্ব’ শুদ্ধ। আরও উল্লেখ্য, ‘আত্ব’/‘আত্বক’ নয়− ‘আত্ম’/‘আত্মক’ শুদ্ধ। যথা: আত্মজ্ঞান, আত্মগোপন, একাত্ম, আক্রমণাত্মক, ধনাত্মক, ঋণাত্মক, ভ্রমাত্মক, ধ্বংসাত্মক, মারাত্মক, সর্বাত্মক।

০২. -তা (তৃচ্)

শব্দের শেষে ঈ-কার থাকলে এবং পরে তা (প্রত্যয়) যুক্ত হলে ঈ > ই হয়। যথা:

অপরিণামদর্শী + -তা = অপরিণামদর্শিতা, ঊর্ধ্বগামী + -তা = ঊর্ধ্বগামিতা, কার্যকারী + তা = কার্যকারিতা, দ্বিচারী + -তা =দ্বিচারিতা, দূ্রদর্শী + তা = দূ্রদর্শিতা, নিম্নগামী + -তা = নিম্নগামিতা, অন্তর্মুখী + -তা = অন্তর্মুখিতা, বহির্মুখী + -তা = বহির্মুখিতা, কর্মমুখী + -তা = কর্মমুখিতা, প্রতিদ্বন্দ্বী + -তা = প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিবন্ধী + -তা = প্রতিবন্ধিতা, বহুমুখী + -তা = বহুমুখিতা, বাগ্মী + -তা = বাগ্মিতা, স্ববিরোধী + -তা = স্ববিরোধিতা, রাষ্ট্রদ্রোহী + -তা = রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সত্যবাদী + -তা = সত্যবাদিতা, স্বেচ্ছাচারী + -তা = স্বেচ্ছাচারিতা।

কিন্তু √গ্রহ্ + তৃ (তৃচ্) = গ্রহীতা শুদ্ধ।  

০৩. -আলি

ক. সাদৃশ্য বোঝাতে

      সোনা + -আলি = সোনালি (− যুগ)। তদ্রূপ, রুপালি (− জ্যোৎস্না), পাটালি (− গুড়)।

খ. ভাব বোঝাতে

     মেয়ে + -আলি = মেয়েলি। তদ্রূপ, চতুরালি, মিতালি।

গ. জাত বা উৎপন্ন বোঝাতে

     (চৈত্র>) চৈত + আলি = চৈতালি (− রাত)। তদ্রূপ, পৌষালি (− সন্ধ্যা ), পূর্ব > পুব + আলি = পুবালি।

ঘ. অনুরূপ বোঝাতে

     গোড় + -আলি = গোাড়ালি। তদ্রূপ, সুতা + আলি = সুতালি > সুতলি।

ঙ. বৃত্তি বা কর্ম বোঝাতে

     গৃহস্থ + -আলি = গৃহস্থালি । তদ্রূপ, ঘটকালি, ঠাকুরালি, নাগরালি, রাখালি।

০৪. -আবলি

বহুবচন বোঝাতে

কার্য + আবলি = কার্যাবলি । তদ্রূপ, কবিতাবলি (চতুর্দশপদী −), গুণাবলি, ঘটনাবলি, তথ্যাবলি, দীপাবলি > দীপালি (− উৎসব), দৃশ্যাবলি, নামাবলি, নির্দেশাবলি, নিয়মাবলি, পত্রাবলি, প্রশ্নাবলি, বৈশিষ্ট্যাবলি, রচনাবলি, শর্তাবলি, সূত্রাবলি ।

মমিনুল হক

সহকারী অধ্যাপক, বাংলা

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

Tags: No tags

Comments are closed.