WhatsApp Image 2022-07-17 at 3.18.16 PM

দলিতদের কবি নজরুল

বাংলা সাহিত্যে সোনার কাঠির পরশ বুলিয়ে সাহিত্য কাননকে সুশোভিত করেছেন যে কজন কবি, তাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) অন্যতম। নজরুল সাধারণত বিদ্রোহী কবি হিসেবে বরণীয়। কিন্তু তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। তাই তাঁকে শুধু মোটাদাগে ‘বিদ্রোহী’ অভিধায় ভূষিত করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি শুধু বিদ্রোহী কবি নন, প্রেমেরও কবি। তিনি শোষিতদের কণ্ঠস্বর। শোষিতদের তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির পরম বন্ধু। তিনি মানবতাবাদী কবি। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে সাম্যের কথা ।

পরাধীনতা এবং শোষণের নিগড়ে আবদ্ধ জনগোষ্ঠিকে এক চিলতে রোদ এনে দেওয়ার জন্য তাঁর কলম ছিল সদাতৎপর। তিনি নিপীড়িতদের অধিকার আদায়ের জন্য সদা সচেষ্ট ছিলেন যা তাঁর কবিতার পরতে পরতে প্রতিভাত হয়েছে। অজয় নদীর তীরে চুরুলিয়া গ্রাম। আর নদী এবং পাহাড় পরিবেষ্টিত এই চুরুলিয়া গ্রামেই বেড়ে উঠেছেন নজরুল। যারপরনাই নদীর গতিশীলতা এবং পাহাড়ের উচ্চতা তাঁর চরিত্রে প্রস্ফূটিত হয় যা পরবর্তিতে তাঁর কবিতায় অনন্য নিয়ামক হিসেবে প্রযুক্ত হয়।নজরুলের চোখে সবাই সমান।সমাজের জাত-পাত-উঁচু-নিচুর বিভেদ ভেঙ্গে শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তিনি সর্বহারাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সদা তৎপর ছিলেন। তবে নজরুলের সর্বহারা মার্কসীয় সর্বহারা নয়। ঔপনিবেশিক শোষণে পিষ্ট সর্বহারাদের যন্ত্রণাময় জীবন এবং যন্ত্রণা থেকে উত্তরণের আখ্যানই হলো নজরুলের কবিতা।

দলিত বলতে সাধারণত সমাজের নিম্নস্তরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠিকে বোঝানো হয়ে থাকে। সমাজ কাঠামো প্রধানত দুই শ্রেণির জনগোষ্ঠি নিয়ে গঠিত। এক গোষ্ঠি সমাজ নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে অর্থ-বিত্তে দুর্বল জনগোষ্ঠিকেও নিয়ন্ত্রণের ঠিকাদার হিসেবে নিজেদের নিযুক্ত রাখে এবং তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা দলিতদের প্রভু হিসেবে নিজেদের জাহির করে আনন্দ পায়। কাজী নজরুল ইসলাম এই দলিতদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই সৃষ্টি করেছেন চুনিপান্নাসম কবিতাগুচ্ছ। তাঁর কবিতার শিরা-উপশিরায় চৈতালির মতো  ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমাজের শোষিতদের কথা। সমাজ বিনির্মাণে,সভ্যতার বিনির্মাণে, কৃষক-শ্রমিক-কুলি-মজুরদের অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করে কবি লিখেছেন কিছু অসামান্য কবিতা। কায়িক শ্রম দিয়ে যারা মানবসভ্যতাকে যুগযুগ ধরে টিকিয়ে রেখেছেন তারাই দলিত, তারাই আজ সমাজের প্রান্তে বসবাসকারী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এই বিদঘুটে সমাজ তাদের সঠিক ভাবে মূল্যায়ন না করলেও প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিতার ডালপালায় তাদের প্রতি শ্রদ্ধার ফুল সাজিয়ে তাদের মূল্যায়ণ করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় ফুটে উঠেছে দলিতদের শোষিত হওয়ার এবং শোষণকে উপেক্ষা করে বিদ্রোহী হয়ে উঠার চিত্র।

‘‘আসিতেছে শুভদিন,

দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!’’

শোষিতরা যুগযুগ ধরে শোষকদের অত্যাচার সহ্য করবে না। তারাও শোষকদের শোষণ নির্যাতনের কড়া জবাব দিবে একদিন। কবির সঙ্গে যেনো শোষিতদের হাজার বছরের পুরানো আত্মিক সম্পর্ক। তাইতো তাদের সুখে সুখি এবং তাদের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে কবি লিখেছেন:

“তারাই মানুষ, তারাই দেবতা,গাহি তাহাদেরি গান

 তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!’’

প্রেমের কবি নজরুল মানুষে মানুষে সম্প্রীতি চেয়েছেন। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই বিচার করেছেন এবং উচুতলার মানুষ, নিচুতলার মানুষ _ সমাজের এই নিকৃষ্ট নিয়মটি তিনি মানতে নারাজ। মানবতাবাদী কবি মানব মনে সাম্যের মোমবাতি প্রজ্বলনের জন্য আজীবন কবিতার শোণিতধারায় বিদ্রোহ প্রবাহিত করেছেন। তিনি সুষম বন্টণের মাধ্যমে সমাজের উঁচু-নিচু,জাত-পাত বিভেদের ইতি চেয়েছেন।

“গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!”

                                                                                                                                                               মানুষের কবি,মানবতাবাদী কবি,প্রেমের কবি,শান্তির কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত নিপীড়িত শোষিত জনগোষ্ঠীর স্বর ও সুর ধ্বনিত হয়েছে। কবির সঙ্গে এই প্রান্তিকজনগোষ্ঠীর যেন এক আত্মিক সম্পর্ক। শৈশব থেকেই দরিদ্রতার সঙ্গে বাস করতে করতে কবির আত্মোপলব্ধি থেকেই মুলত এই  আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

কবি ‘চোর-ডাকাত’ কবিতায়ও সমাজের উঁচুতলার মানুষের প্রতি ধিক্কার পোষণ করেছেন। কারণ তারাই বড় চোর অথচ তাদের সামাজিক অবস্থানের কারনে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

“ছোটোদের সব চুরি করে আজ বড়োরা হয়েছে বড়ো।  

যারা যত বড়ো ডাকাত-দস্যু জোচ্চোর দাগাবাজ

তারা তত গুণী জাতি সঙ্ঘেতে আজ।’’

নজরুলের কবিতার মূল সুরই হলো মানবতাবাদ এবং মানবের জয়গান। তিনি শুধু সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অধিকার আদায়ে সচেতন ছিলেন না, তিনি যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষণের শিকার হওয়া নারীকুলের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেও কবিতায় শব্দের বাণ নিক্ষেপ করেছেন। নারীরাও সমাজের শোষিতদের কাতারেই দাঁড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে।

নারীদের অধিকার আদায়ে এবং তাদের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে কবি সৃষ্টি করেছেন ‘নারী’ এবং ‘বারাঙ্গনা’।

“নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে

 আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।”

নারীকে শুধু নারী হিসেবে কল্পনা না করে, মানুষ হিসেবে কল্পনা করেছেন কবি। তাই তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে নারীর অধিকার এবং মর্যাদার কথা।

“নাই হ’লে সতী, তবু তো তোমরা মাতা-ভগিনীরই জাতি

তোমাদের ছেলে আমাদেরই মতো, তারা আমাদের

জ্ঞাতি;”

এই অন্তঃসারশূন্য সমাজব্যবস্থায় মানুষের অধিকার খর্ব করাই যেন মানুষের কাজ। সমাজের চোখে ঘৃণ্য বারাঙ্গনার প্রতি এই অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধই কবিকে করে তুলেছে যুগশ্রেষ্ঠ।

নজরুলের কবিতা সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষের জন্য মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতোই প্রশান্তিদায়ক। তারা যেন যুগ যুগ ধরে চাতকের মতো কবির অপেক্ষায়ই ছিলেন। তাদের কাস্তে ও কুঠারের ঝনঝনানিতে, শ্রমে ও ঘামে নজরুলের কবিতা বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে। সময় এসেছে নজরুলচর্চা বেগবান করার।

মুন্নি আক্তার সুমি

প্রভাষক, বাংলা

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

Tags: No tags

Comments are closed.