WhatsApp Image 2022-08-22 at 11.53.20 AM

উপসর্গ ও বানান

‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) মাইকেল মধুসূদন দত্তের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এর বিষয়বস্তু ৯টি সর্গে বিভক্ত।

এখানে ‘সর্গ’ (‘স্বর্গ’ নয়) অর্থ অধ্যায় বা কাহিনিভাগ।

উপ + সর্গ = উপসর্গ। এর দুটি অর্থ প্রচলিত আছে− ১. রোগলক্ষণ, ২. অর্থহীন বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি । আমরা এখানে দ্বিতীয়টি (Prefix − অর্থহীন বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও স্বচ্ছ ধারণা নেব।

আপনি স্বপরিবার নিমন্ত্রিত।

এখানে ‘স্বপরিবার’ না ‘সপরিবার’ শুদ্ধ? 

‘স্ব’ (সর্বনাম) অর্থ নিজ। আর ‘স’ (উপসর্গ) অর্থ সহ। অর্থাৎ পরিবারসহ (with family)। ব্যাকরণমতে, ‘সপরিবার’ শুদ্ধ। তদ্রূপ, ‘স্বস্ত্রীক’ নয়− ‘সস্ত্রীক’ শুদ্ধ। ‘স্ববান্ধব’ নয়− ‘সবান্ধব’ শুদ্ধ। ‘স্বার্থক’ নয়−  স + অর্থক = ‘সার্থক’ শুদ্ধ।

 ব্যাকরণমতে, উপ + √সৃজ্ + অ (ঘঞ্) = উপসর্গ। অথবা, উপ (ক্ষুদ্র) যে সর্গ (সৃষ্টি) = উপসর্গ। অতএব উপসর্গ হচ্ছে একপ্রকার ‘ক্ষুদ্রপদ’ বা ‘ক্ষুদ্রসৃষ্টি ‘। প্রশ্ন হচ্ছে, উপসর্গের সাহায্যে আমরা কী করি? উত্তর হচ্ছে, নতুন অর্থবাচক শব্দ সৃষ্টি করি এবং তাতে বাংলা ভাষা শব্দসম্পদে সমৃদ্ধ হয়। অতএব উপসর্গ ‘ক্ষুদ্র’ হলেও তুচ্ছ বা উপেক্ষণীয়  নয়। এর সৃষ্টিশীলতা অফুরন্ত।  

একটি উদাহরণ দিই :

বাংলা উপসর্গ− আ

অর্থ উদাহরণ
অভাব/না অর্থেআকাঁড়া, আকাটা, আগোছালো, আচাঁছা/আছোলা, আচালা, আছাঁকা, আছাঁটা,আছোঁয়া, আঝাল/আঝালা, আঝোড়া, আঢাকা, আনাড়ি, আবাছা, আবাটা, আভাজা,  আধোয়া, আপেষা, আফাটা, আফোটা, আমোছা, আরাঁধা, আলুনি।
মন্দ/নিকৃষ্ট অর্থেআকাঠ/আকাঠা, আগাছা, আকথা, আকাল, আঘাট/আঘাটা, অকর্ম > আকাম

সংস্কৃত উপসর্গ− আ

অর্থ  উদাহরণ
পর্যন্ত অর্থেআকণ্ঠ, আকর্ণ, আজন্ম, আজীবন, আজানু, আপ্রাণ, আপাদমস্তক, আবক্ষ (− মূর্তি), আবাল্য, আব্রহ্ম, আভূমি, আমরণ, আমৃত্যু, আসমুদ্র 
ঈষৎ অর্থেআকুঞ্চিত, আকম্প, আতাম্র, আনত, আনম্র,  আরক্ত/আরক্তিম, আপাণ্ডুর, আভাস, , আশুষ্ক
বিপরীত অর্থেআদান, আগমন, আরোগ্য
অভিমুখে ক্রিয়া অর্থেআক্রমণ, আকর্ষণ
সম্যকরূপে অর্থেআচ্ছাদন, আবাসন, আবেগ, আভোগ, আবাস
ব্যাপ্ত/পূর্ণ  অর্থেআকীর্ণ (জন + আকীর্ণ = জনাকীর্ণ )
গন্ধগ্রহণ অর্থেআঘ্রাণ (মধুকর কমলের − নিয়েছে)
অসিদ্ধ অর্থেআতপ (− চাল)
দম্ভ অর্থেস্পর্ধা  > আস্পর্ধা (আদি স্বরাগম)

ব্যাকরণমতে,  উপসর্গ ‘শব্দ’ নয়− ‘শব্দাংশ’ বা ‘অব্যয়জাতীয় শব্দাংশ’।

নিচের বাক্য-দুটি লক্ষ করা যাক:

বাঘ ও সিংহ হিংস্র প্রাণী।

বাঘ বা সিংহ বনের রাজা।

এখানে ‘ও’, ‘বা’ অব্যয়পদ, কিন্তু উপসর্গ নয়।

ব্যাকরণমতে, যেসকল অব্যয় ধাতু বা শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন অর্থবাচক শব্দ গঠন করে, সেগুলোই উপসর্গ। অর্থাৎ উপসর্গ হচ্ছে কোনো পদের পূর্বস্থ ক্ষুদ্রপদ। তবে এগুলো স্বাধীন পদ নয়। যথা:  আ + কণ্ঠ = আকণ্ঠ, উপ + কূল = উপকূল, সম্ + প্রীতি = সম্প্রীতি। এখানে ‘আ’, ‘উপ’, ‘সম্’  উপসর্গ।

উপসর্গ ৩ প্রকার−

১. বাংলা উপসর্গ (২১টি)

২. সংস্কৃত উপসর্গ (২০টি)

৩. বিদেশি উপসর্গ (২৫টি?)

ব্যাকরণমতে, বাংলা উপসর্গ বাংলা শব্দের পূর্বে এবং সংস্কৃত উপসর্গ সংস্কৃত শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে দুয়েকটি ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন− ‘অ’। বহু বাংলা ও সংস্কৃত শব্দের পূর্বে ‘অ’ যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ত,  বিদেশি উপসর্গ সকল প্রকার (বাংলা, সংস্কৃত ও বিদেশি) ধাতু ও শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়। তৃতীয়ত, ৪টি উপসর্গ ( আ, সু, বি, নি ) বাংলা ও সংস্কৃত উভয় ভাষায় ব্যবহৃত হয়।

   কতিপয় উপসর্গযুক্ত শব্দ

উল্লেখ্য, প্র + ছায়া = প্রচ্ছায়া, অপ + ছায়া = অপচ্ছায়া, প্রতি + ছায়া = প্রতিচ্ছায়া। এগুলো সন্ধির নিয়মে সিদ্ধ। উৎ + বাহু = উদ্বাহু, উৎ + শ্বাস = উচ্ছ্বাস, উৎ + শৃঙ্খল = উচ্ছৃঙ্খল। এগুলোও

সন্ধির নিয়মে সিদ্ধ । আরও উদাহরণ− বি + উৎপত্তি = ব্যুৎপত্তি, প্রতি + উপকার = প্রত্যুপকার, প্রতি + ইতি = প্রতীতি, প্র + অগ্রসর = প্রাগ্রসর, , সম্ + মান = সম্মান (-জনক), সম্ + উজ্জ্বল = সমুজ্জ্বল, সম্ + মার্জনী = সম্মার্জনী (ঝাঁটা) , সম্ + মিলন = সম্মিলন, সম্ + আরূঢ় = সমারূঢ়, সু + অল্প = স্বল্প। অন্যান্য শব্দ: পরা + অয়ন = পরায়ণ (ণত্ব বিধি), পরি + সেবা = পরিষেবা ( ষত্ব বিধি), সু + সুপ্তি = সুষুপ্তি (ষত্ব বিধি) ।

উল্লেখ্য, সাধারণত একটিমাত্র উপসর্গ ধাতু বা শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন, অ-সম্-পূর্ণ = অসম্পূর্ণ, অন-অতি-বৃহৎ = অনতিবৃহৎ, সম্-প্র-দান = সম্প্রদান। আরও উল্লেখ্য, কতিপয় উপসর্গযুক্ত শব্দে শিষ্ট  কথ্যরূপ ব্যবহৃত হয়। যথা: অগণিত > অগুনিত, অপিচ (অধিকন্তু) > আরও, আগোছাল > আগোছালো, আফুটা > আফোটা, কমবখ্ত > কমবক্ত, পরিষদ > পর্ষদ, বদমায়েস > বদমাশ, স্পর্ধা > আস্পর্ধা, সম্বাদ > সংবাদ, সম্বৎসর > সংবৎসর, সম্বরণ > সংবরণ, সম্বিৎ > সংবিৎ, সম্বর্ধনা > সংবর্ধনা।

পরিভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রে উপসর্গ  গুরুত্বপূর্ণ। শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, অপরিহার্য।

নিচের তালিকাটি লক্ষ করা যাক:

Anonymous – বেনামী (− লেখক)

Convocation – সমাবর্তন (প্রথম −)

Conference – সম্মেলন (কর্মী-)

Circular – পরিপত্র ( সরকারি −)

Directorate – অধিদপ্তর (স্বাস্থ্য −)

Faculty – অনুষদ (বিজ্ঞান −)

Invention – উদ্ভাবন (টিকা −)

Informal – অনানুষ্ঠানিক ( − পোশাক)

Immigrant – অভিবাসী (তিনি যুক্তরাষ্ট্রে −)

Leap-Year – অধিবর্ষ ( − ২০২৪)

Notice – বিজ্ঞপ্তি (নিয়োগ − )

Opening – উদ্বোধন (অনুষ্ঠান −) 

Perfume – সুগন্ধি (চন্দনের −)

Project – প্রকল্প (আশ্রয়ণ −)

Provost – প্রাধ্যক্ষ (হল −)

Registration – নিবন্ধন (জন্ম-)

Satellite – উপগ্রহ (বঙ্গবন্ধু −)

Supperman – অতিমানব

Synonym – প্রতিশব্দ (বাংলা −)

Terminology – পরিভাষা (রসায়ন −)।

এখানে অনানুষ্ঠানিক, উদ্বোধন, উদ্ভাবন, প্রাধ্যক্ষ, সমাবর্তন, সম্মেলন ও সমারূঢ় সন্ধিবদ্ধ শব্দ। এগুলোর অর্থ, বানান ও ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।

মমিনুল হক

সহকারী অধ্যাপক

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ

Tags: No tags

Comments are closed.